শাক্ত পদাবলীতে উল্লেখিত সমাজ চিত্রের বর্ণনা দাও (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার, বাংলা মেজর)।
•আমরা জানি যে, শাক্ত পদাবলীতে শুধুমাত্র তৎকালীন সময়ে শুধুমাত্র শক্তির সাধনা করা হয়নি, শক্তির ভজনা করা হয়নি। আর সেই হিসেবে শাক্ত পদাবলী কেবল ধর্মীয় ভক্তির প্রকাশ নয়, বরং এটি তৎকালীন বাঙালি সমাজের এক জীবন্ত দলিল। আর সেই দলিলে অষ্টাদশ শতক এবং তার পরবর্তীকালের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালির দৈনন্দিন জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মানসিকতার এক সুস্পষ্ট চিত্র শাক্ত পদাবলীতে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিফলিত সেই সমাজচিত্রে আমরা দেখতে পাই-
•পারিবারিক জীবনের প্রতিচ্ছবি•
•বাৎসল্যরস ও মাতৃ হৃদয়ের আকুতিঃ শাক্ত পদাবলীর একটি প্রধান অংশ হলো আগমনী ও বিজয়া গান।যে গানগুলি উমা-মেনকার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে রচিত।এই পদগুলিতে মা মেনকার কন্যা উমার জন্য যে অসীম বাৎসল্য, স্নেহ, উদ্বেগ ও বিরহ ফুটে উঠেছে, তা বাংলার প্রতিটি মায়ের চিরন্তন মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।উমার পতিগৃহে যাওয়া, তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনা এবং আবার বিদায় জানানোর যে আবেগঘন মুহূর্তগুলি, তা যেন তৎকালীন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস্তব চিত্র। ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন যে-
"আগমনী ও বিজয়া সংগীত রচয়িতা কবিগণ মোটামুটি ভাবে মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উদ্ভূত।... ফলে আগমনী ও বিজয়া সংগীতের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের ছবিটি যেমন বাস্তব রূপে ফুটে উঠেছে তেমনি আমাদের অন্য কোন জাতীয় সাহিত্যে আর এমনটি দেখিতে পাই না।"
•পিতার উদ্বেগঃ শক্ত পদাবলীতে চিত্রিত গিরিরাজ হিমালয় চরিত্রটি আমাদের বাঙালি পিতার প্রতিরূপ যেন প্রতিরূপ।আর সেখানে মেনকার আকুতি, কন্যাকে আনার জন্য তার স্বামীর প্রতি অনুযোগ এবং গিরিরাজের কিছুটা নির্বিকার, কিন্তু গভীর স্নেহপ্রবণ চরিত্র - এ সবই তৎকালীন পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্কের জটিলতা তুলে ধরে। শুধু তাই নয়-
•জামাতার চরিত্র ও দারিদ্র্যের প্রভাবঃ শাক্ত পদাবলীতে দেবাদিদেব মহাদেবকে শ্মশানচারী, ভিক্ষাজীবী, নেশাগ্রস্ত, সংসারবিরাগী এবং দরিদ্র কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আর সেই তুলনা করাটাই স্বাভাবিক। কারণ তার একাধিক বিবাহ এবং দারিদ্র্যতা।যা মা মেনকার উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। আসলে এটি তৎকালীন সমাজের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে কন্যা বিবাহ দেওয়ার যে সামাজিক সমস্যা ও দুশ্চিন্তা ছিল, তার সুস্পষ্ট চিত্রন সার্থক পরবর্তীতে তুলে ধরা হয়েছে। তবে সেই সাথে আছে-
•তৎকালীন সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা•
•দারিদ্রতা ও আর্থিক অনিশ্চয়তাঃ শাক্ত পদাবলীতে রামপ্রসাদ সেনের কিছু পদে তৎকালীন আর্থিক দৈন্যদশা ও সমাজের বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। আর সেই চিত্রে আমরা দেখি-
প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তাঁর নামেতে নিলাম জারি। ঐ যে পান বেছে খায় কৃষ্ণপান্তি, তারে দিলে জমিদারি।।"
আসলে শক্ত পদাবলীতে এই পঙ্তিগুলি তৎকালীন জমিদারী প্রথা, রাজস্ব আদায় এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশার ইঙ্গিত দেয়। শাক্ত পদাবলীতে বর্ণিত শিবের দরিদ্রতা এবং মেনকার উমার গয়না বা বসন-ভূষণ বিক্রি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৎকালীন সমাজের আর্থিক অনটনের প্রতিফলন।
•তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিঃ অষ্টাদশ শতকে বাংলা ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা পূর্ণ।আর সেই সময়ে মোগল শাসনের অবসান, স্বাধীন নবাবী আমলের বিশৃঙ্খলা, বর্গীর আক্রমণ, দস্যুদের হানা, এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব বিস্তার - এই সবই সাধারণ মানুষের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা ও দুর্দশা নিয়ে আসে। যদিও সরাসরি এর উল্লেখ কম, তবে রামপ্রসাদের গানে যে জীবন-জগতের প্রতি এক ধরণের হতাশা ও ঈশ্বরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা দেখা যায়, তা এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিরই ফলশ্রুতি।
• ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা •
•বালবিবাহ ও গৌরিদানঃ শাক্ত পদাবলী হতে আমরা জানতে পারি যে, উমার বাল্যকালেই মহাদেবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর এই বিবাহ কার্যটি মেনকার উমার জন্য যে উদ্বেগ, তা তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ এবং গৌরীদান প্রথার ইঙ্গিত দেয়। শুধু তাই নয়-
•দেবাদিদেবের সংসার বিমুখতাঃ দেবাদিদেব মহাদেবের সংসারবিমুখতা, নেশাগ্রস্ততা এবং শ্মশানচারী হওয়ার যে বর্ণনা, তা তৎকালীন সমাজে কিছু সাধক বা ফকিরের সংসারবিমুখ জীবনের প্রতিরূপ। আবার, শাক্ত পদাবলীর মূল সুরই হলো শক্তি সাধনা, যা তৎকালীন বাংলার ধর্মীয় জীবনে তন্ত্র ও মাতৃপূজার ব্যাপক প্রভাবের প্রমাণ।
• তৎকালীন লোকায়িত জীবন •
•আমরা জানি শাক্ত পদাবলী কেবল দেবদেবীকে নিয়ে রচিত হলেও, এর চরিত্রগুলি পৌরাণিক সত্তা থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ বাঙালির চরিত্রেই পরিণত হয়েছে। কৈলাস ও মানস সরোবর যেন বাংলার পানাপুকুর ও আমবাগান হয়ে উঠেছে। এর ফলে পদগুলি মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ এবং বাঙালির পরিচিত জীবনের ছবি হয়ে উঠেছে। সেই সাথে-
•শাক্ত পদাবলীর পদগুলিতে যে রাগ, অভিমান, স্নেহ, বেদনা ও আনন্দের প্রকাশ ঘটেছে, তা শাশ্বত মানবীয় অনুভূতিগুলিরই প্রতিফলন, যা তৎকালীন সমাজের সাধারণ মানুষের আবেগ ও সংবেদনশীলতাকে তুলে ধরে।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শাক্ত পদাবলী একদিকে যেমন বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, ঠিক তেমনই এটি অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালির পারিবারিক জীবন, সামাজিক প্রথা, আর্থিক বাস্তবতা এবং মানসিকতার এক মূল্যবান চিত্র তুলে ধরে। এর মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের বহু অজানা দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।
Comments
Post a Comment