সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় (4th. Sem) ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী গোয়েন্দা কাহিনীতে বিজ্ঞান ও কল্পনার এক অসাধারণ মেলবন্ধনে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে- আলোচনা করো।
সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় 'ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী' কল্প কাহিনীতে বিজ্ঞান ও কল্পনার এক অসাধারণ মেলবন্ধনে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন আলোচনা করো।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,সত্যজিৎ রায় তাঁর কালজয়ী অনন্য সৃষ্টি 'ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী'।আর সেই ডায়েরীতে তিনি বিজ্ঞান এবং কল্পনার এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। যেখানে এই গল্পে বৈজ্ঞানিক তথ্যের নির্ভুল প্রয়োগের পাশাপাশি তার অদম্য কল্পনাশক্তি পাঠককে এক নতুন জগতে নিয়ে যায়। আর সেই জগতে আমরা দেখি-
• বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও কল্পনার বিস্তারে সত্যজিৎ রায়ঃ সত্যজিৎ রায় প্রোফেসর শঙ্কুর মহাকাশযাত্রাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে,সেখানে বৈজ্ঞানিক যুক্তি পুরোপুরি অনুপস্থিত নয়। যেখানে রকেটের নকশা, জ্বালানির ধারণা এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উল্লেখ গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।আর সেখানে আমরা দেখতে পাই যে-
রকেটের ধারণাঃ গল্পে শঙ্কু তার নিজের তৈরি রকেটে করে মহাকাশে পাড়ি দেন। যদিও সে সময়ে এই ধরনের রকেট বানানো ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু লেখক রকেটের গঠন এবং কার্যপ্রণালী সম্পর্কে কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণা দিয়েছেন,যা পাঠককে মনে করিয়ে দেয় যে, এটি কেবল অলীক স্বপ্ন নয়, বরং বিজ্ঞানের হাত ধরেই এই স্বপ্ন একসময় সত্যি হতে পারে। আর সেখানে-
মহাকাশ যাত্রা ও তার পরিবেশঃ মহাকাশে অক্সিজেনের বড়ই অভাব।তবে লেখক মাধ্যাকর্ষণহীনতা এবং অন্যান্য ভৌত ধারণাগুলো খুব সহজভাবে তুলে ধরেছেন আলোচ্য বিষয়ে। যার ফলে পাঠকদের কাছে মহাকাশ ভ্রমণের একটা বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।
•বৈজ্ঞানিক উড়ান পরিকল্পনায়•
আলোচ্য গল্পে শঙ্কুর বিভিন্ন আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও কল্পনার মেলবন্ধনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয়,এগুলো একদিকে যেমন শঙ্কুর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয় দেয়, তেমনি অপরদিকে কল্পনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।আর সেই দিগন্ত উন্মোচনে আমরা দেখি-
বিধুশেখর রোবটঃ বিধুশেখর আলোচ্য গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।যে চরিত্রটি গল্পের শুরুতে বিধুশেখর ছিল একটি যান্ত্রিক রোবট।যে রোবট কেবলমাত্র শঙ্কুর নির্দেশ পালন করত। কিন্তু পরে সে স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিমত্তা লাভ করে এবং তার নিজের স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে শুরু করে। আর সেখানে বিধুশেখরের আবেগ এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পাঠকের কল্পনাকে এক নতুন মাত্রা এনে দেয়। পাশাপাশি আমরা দেখি-
বটিকা ইন্ডিকাঃবটিকা ইন্ডিয়া একটি বিশেষ বড়ি।যে বড়ি ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণ করতে সক্ষম। তবে এই ধরনের আবিষ্কার দৈনন্দিন জীবনের বৈজ্ঞানিক সমাধানের এক কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরে।আর সেখানে-
অ্যানিহিলিন সঙ্গীতঃআলোচ্য গ্ৰন্থে এই বিধ্বংসী অস্ত্রের ধারণা শঙ্কুর বৈজ্ঞানিক মেধার এক ভিন্ন দিক পাঠকের সামনে তুলে ধরে।আর এটি বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে কীভাবে আত্মরক্ষা বা আক্রমণের পথ তৈরি হতে পারে, তার এক কল্পিত রূপ এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আবার-
• নতুন প্রাণের সন্ধান ও ভিনগ্ৰহের জীবনঃ ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী গল্পের সবচেয়ে বড় কল্পনা বা আশ্চর্যের দিকটি হলো মঙ্গল এবং টাফা গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব এবং তাদের সভ্যতা।আর সেই প্রাণের অস্তিত্ব ও সভ্যতায় দেখি-
মঙ্গল গ্ৰহে প্রাণের অস্তিত্বঃ মঙ্গল গ্রহে প্রফেসর শঙ্কু যে অদ্ভুত প্রাণীদের মুখোমুখি হয়ে তাদের সম্পর্কে ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন। আর সেই বর্ণনাটি বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। সেই ভিত্তিভূমিতে আমরা দেখি,এই প্রাণীরা কীভাবে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছে, তা নিয়ে লেখকের বর্ণনা পাঠকের মনে বড্ড বেশি কৌতূহল জাগায়। শুধু তাই নয়, সেখানে-
টাফা গ্ৰহের সভ্যতাঃটাফা গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাথে শঙ্কুর সাক্ষাৎ বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই প্রাণীদের জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ মানুষের কাছে ভিনগ্রহের সভ্যতার এক ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরে। এই অংশে লেখক কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন বটে, কিন্তু সেই কল্পনা বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির সাথে সংযুক্ত হয়েছে—যেমন, তারা কীভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে, তাদের সমাজ ব্যবস্থা কেমন, ইত্যাদি।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী গল্পে সত্যজিৎ রায় অত্যন্ত সফলভাবে দেখিয়েছেন যে, বিজ্ঞান শুধুমাত্র কঠিন সূত্র আর তত্ত্বের সমষ্টি নয়।বরং বলা যায় এটি কল্পনার ডানা মেলে নতুন বিশ্ব গড়ার এক অফুরন্ত উৎস। তার লেখনীর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে কল্পনার ভিত্তি যদি সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক ধারণার উপর স্থাপিত হয়, তাহলে সেই কল্পনা হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয় এবং বিশ্বাসযোগ্য। আর সেই দৃষ্টিতে এই গল্পটি কেবল একটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী নয়, বরং এটি বিজ্ঞানমনস্কতা এবং অজানাকে জানার অদম্য কৌতূহলের এক মজাদার বিষয়।
Comments
Post a Comment