Skip to main content

সামাজিক নাটক(4th.Sem Major )কাকে বলে স্বাভাবিক নাটকের বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ করে একটি সার্থক সামাজিক নাটক আলোচনা করো।

সামাজিক নাটক কাকে বলে সামাজিক নাটকের বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ করে একটি সার্থক সামাজিক নাটক আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সেমিস্টার, বাংলা মেজর)।

           •সামাজিক নাটকঃ আমরা জানি যে,সামাজিক নাটক বলতে এমন এক ধরনের নাটককে বোঝায় যা সমাজের বাস্তব সমস্যা, রীতিনীতি, কুসংস্কার, সংঘাত এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। তবে এই ধরনের নাটকে সাধারণত সমসাময়িক সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্যায়, বৈষম্য বা নৈতিক অধঃপতনকে তুলে ধরা হয়।আর সমাজের সেইসকল দিকগুলি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে দর্শককে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। তাই -

        •সামাজিক নাটক কেবলমাত্র বিনোদন নয়, বরং সমাজকে প্রশ্ন করতে ও পরিবর্তনের দিকে চালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।আর এই প্রেক্ষিতে আমরা সামাজিক নাটকের যে সকল বৈশিষ্ট্যগুলি দেখি তা নিম্নে আলোচনা করা হলো,-

       •বাস্তবিক বিষয়ঃ সামাজিক নাটকের মূল ভিত্তি হলো সমাজের বাস্তব ঘটনাপ্রবাহ। এতে কল্পনার চেয়ে বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সমকালীন সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়।

     •সামাজিক সমস্যাঃসামাজিক নাটকে যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, কুসংস্কার, দারিদ্র্য, শ্রেণি বৈষম্য, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, বেকারত্ব, নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি সামাজিক সমস্যাগুলো প্রাধান্য পায়। নাট্যকার এই সমস্যাগুলোকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেন।

      •উদ্দেশ্যমূলক বার্তাঃ সামাজিক নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো দর্শককে সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা এবং সমাধানের পথ দেখানো বা চিন্তা উদ্রেক করা। অনেক সময় এর মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে একটি নৈতিক বা সামাজিক বার্তা দেওয়া হয়।

     •পরিচিত চরিত্রঃ সামাজিক নাটকের চরিত্রগুলো সাধারণত সমাজের বিভিন্ন স্তরের চেনা মুখ, যাদের সঙ্গে দর্শকরা নিজেদের বা তাদের পরিচিতদের মিল খুঁজে পান। এতে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং দর্শক তাদের সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারে।

       •নাটকের সংলাপঃসংলাপের ব্যবহার সামাজিক নাটকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনের ভাষা, উপভাষা এবং প্রচলিত বচন ব্যবহার করা হয়, যা নাটককে আরও বাস্তবসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।

       •দ্বন্দ্ব ও সংঘাতঃ সামাজিক নাটকে চরিত্রগুলোর মধ্যে বা ব্যক্তি বনাম সমাজের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা যায়। এই দ্বন্দ্বগুলোই নাটকের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সমস্যাগুলোর গভীরতা তুলে ধরে।

       •সমাজ সংস্কারঃ অনেক সামাজিক নাটকে সমাজ সংস্কারের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। নাট্যকার নাটকের মাধ্যমে প্রচলিত প্রথার সমালোচনা করে এবং একটি উন্নত সমাজের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন।

      •নাটকের পরিণতিঃ সামাজিক নাটকের পরিণতি সবসময় সুখের নাও হতে পারে। অনেক সময় সমাজের কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে এটি বেদনাদায়ক বা হতাশাজনক পরিণতি লাভ করে, যা দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

একটি সার্থক সামাজিক নাটক আলোচনা-                                 •নীলদর্পণ• দীনবন্ধু মিত্র।

         •আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক সামাজিক নাটক হিসেবে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ'(১৮৬০) এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। শুধু তাই নয়,এই নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল এবং এর গভীর সামাজিক প্রভাব ছিল। আর সেই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে-

নাটকের পটভূমি ও বিষয়বস্তুঃ 'নীলদর্পন'নাটকের মূল বিষয়বস্তু হলো ১৯শ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার গ্রামীণ জীবনে নীলকর সাহেবদের অকথ্য অমানবিক অত্যাচার। ব্রিটিশ নীলকররা কীভাবে স্থানীয় কৃষকদের উপর জোর করে নীল চাষে বাধ্য করত, তাদের জমি কেড়ে নিত, ফসল নষ্ট করত, এবং নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালাত, তারই এক মর্মস্পর্শী চিত্র এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে। নাট্যকার নিজেই সরকারি কর্মচারী হিসেবে নীলকরদের অত্যাচারের সাক্ষী ছিলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এই নাটক রচনা করেন। আর সেই নাটকে আমরা যে সকল চরিত্রসমূহকে দেখি তারা হলেন-

 গোলক বসু, যিনি এই নাটকে একজন কৃষক এবং তিনি নীলকরদের চরম অত্যাচারে সর্বস্বান্ত হন। এরই পাশাপাশি আছে সাধুচরণ, রাইচরণ, যারাও নীলকরদের অত্যাচারে নির্যাতিত কৃষক।আছে নবীন মাধব,সাধু মাধব,বেবতী,সরলা প্রমুখ চরিত্রসমূহ। যারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যাচারিত হন। আবার কেউবা ই্ংরেজদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। তবুও নাটকটি-

বাস্তবিকতায় ভরাঃ 'নীলদর্পন' নাটকের প্রতিটি ঘটনা, চরিত্র এবং সংলাপ ছিল তৎকালীন সমাজের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। নীলচাষীদের দুরবস্থা, নীলকরদের বর্বরতা, এবং স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা অত্যন্ত বাস্তব সম্মতভাবে চিত্রিত হয়েছে।আর সেই বাস্তবতার সাথে নাটকটিতে উঠে আসে-

সামাজিক সমস্যাঃ নীলদর্পণ নাটকটিতে নীলচাষ কেন্দ্রিক একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এটি কেবল অত্যাচারীর অত্যাচারের বর্ণনা নয়, বরং পরাধীন সমাজে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নির্মমতাকে তুলে ধরে।

উপদেশমূলক নীলদর্পনঃ নাটকটি সরাসরি নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। এটি কেবল বাংলাতেই নয়, ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ইউরোপেও নীলচাষীদের দুর্দশার কথা ছড়িয়ে দেয়, যা নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরিতে অন্যতম ভূমিকা রাখে।

 সংলাপঃ নীলদর্পণ নাটকের সংলাপগুলি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং সংলাপগুলি আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহার করে এর বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে গ্রাম্য চরিত্রগুলির মুখের ভাষা তাদের সামাজিক অবস্থান ও দুর্দশাকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। পাশাপাশি-

 দ্বন্দ্বঃ নাটকের প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল শোষক নীলকরদের সঙ্গে শোষিত কৃষকদের। এছাড়াও, নবীন মাধব ও সাধু মাধবের মধ্যে নীলচাষের স্বপক্ষে-বিপক্ষে মতের পার্থক্যও এক ধরনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। অতঃপর-

ট্রাজিক পরিণতিঃ আমরা জানি যে, 'নীলদর্পন' একটি বিয়োগান্তক নাটক। আর সেই নাটকে নীলকরদের অত্যাচারে গোলোক বসুর পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়, সাধুচরণ মারা যায় এবং রেবতী উন্মাদ হয়ে যায়।নাটকের এই সকল ট্র্যাজিক পরিণতি তৎকালীন সমাজের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে এবং দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,'নীলদর্পন' নাটকটি রচনার পর গোটা বাংলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বলা যায় এই আলোড়ন নীল বিদ্রোহকে আরও উসকে দেয় । যার ফলে ইংরেজ সরকারও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। নীলচাষীদের আন্দোলন,নীলচাষীদের অত্যাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে দেয়। এই নাটকটি নাট্যকার মধুসূদন দত্তের কেবল একটি সাহিত্যকর্ম ছিল না, এটি ছিল একটি সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার। আর এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি 'নীলদর্পণ' নাটকটি অবশ্যই একটি সার্থক সামাজিক নাটক।


Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...