সৈয়দ মুজতবা আলী(6th Semester CC-14)রচিত 'দেশ বিদেশ'রচনাটি কোন প্রেক্ষিতে সরস,মেধাবী এবং বর্ণময় হয়ে উঠেছে তা আলোচনা ।
সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত 'দেশ বিদেশ'রচনাটি কোন প্রেক্ষিতে সরস,মেধাবী এবং বর্ণময় হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ষষ্ঠ সেমিস্টার, বাংলা অনার্স)
• আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশ বিদেশ' রচনাটি বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি এবং সম্পদ।তবে এটি কেবলমাত্র একটি ভ্রমণকাহিনী নয়, বরং লেখক মুজতবা আলীর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, পাণ্ডিত্য, সূক্ষ্ম রসবোধ এবং বর্ণময় উপস্থাপনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সেই প্রেক্ষিতে এই গ্ৰন্থটি ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে অধ্যাপনা করার সময়কার তার অভিজ্ঞতা এবং সেই সময়ের আফগানিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই রচনার মূল উপজীব্য বিষয়।আর সেখানে আমরা দেখতে পাই -
১) সরসতাঃ'দেশে বিদেশে'রচনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর সরসতা। মুজতবা আলী অত্যন্ত হালকা চালে, মজাদার ভঙ্গিতে তার অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করেছেন। আর সেই অভিজ্ঞতা তিনি হাস্যরসের উজ্জ্বলতায় সৃষ্টি করে তুলে ধরেছেন পাঠক দরবারে।আর সেখানে -
•চরিত্র চিত্রায়ণে সরসতাঃ কাবুলের সাধারণ মানুষ, রিকশাওয়ালা, সহকর্মী, ছাত্র - সবার চরিত্রই তিনি নিজস্ব রসবোধের ছোঁয়ায় জীবন্ত করে তুলেছেন। যেমন, "আবদুর রহমান" চরিত্রটি তার বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করে।
•ভাষার সরসতাঃ লেখক মুজতবা আলীর শব্দচয়ন, বাক্য গঠন এবং প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহারও সরসতা বাড়িয়েছে। তিনি বিভিন্ন ভাষার শব্দ ও বাগধারা অবলীলায় ব্যবহার করে ভাষার এক নতুন রূপ সৃষ্টি করেছেন। আর সরল,সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহারে রচনাটি রসবোধের পরিচয় বাহকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
•ঘটনা বিবরণে রসবোধঃ তুচ্ছ মামুলি ঘটনাকেও তিনি তাঁর রচনায় এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে পাঠক হেসে লুটোপুটি খায়। যেমন-যাত্রাপথে এক ফিরিঙ্গির সঙ্গে তার আলাপচারিতা বা খাবারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যে সূক্ষ্ম কৌতুক সৃষ্টি করেছেন, তা অতুলনীয় বলা যেতে পারে। পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসের মে তিনি নিজের সম্পর্কেও সরস মন্তব্য করতে পিছপা হননি। আর এই সকল বিষয়গুলি রচনাটি রসবোধের পরিচয় করিয়ে দেয়।
২) মেধা, পান্ডিত্যঃ এই পর্বে আমরা দেখি যে,মুজতবা আলীর অসাধারণ মেধা এবং পাণ্ডিত্য 'দেশ বিদেশ' রচনার এক অসাধারণ ভাষাশৈলী মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই প্রেক্ষিতে আমরা এখানে দেখি-
•ভাষাবিশরদ মুজতবা আলীঃ মুজতবা আলী প্রায় ১৮টি ভাষা জানতেন। তার লেখায় ফারসি, আরবি, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দ ও প্রবচনের ব্যবহার তার গভীর ভাষাজ্ঞানের পরিচয় বহন করে। বলা যেতে পারে এই ভাষার মিশ্রণ তার লেখাকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
•সাংস্কৃতিক মনস্কতাঃ মুজতবা আলী আলোচ্য রচনাটি তে কেবল আফগানিস্তানের বর্তমান চিত্রই তুলে ধরেননি, বরং আফগানিস্তানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতিগত বৈচিত্র্য এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান প্রদর্শন করেছেন। বিশেষ করে আমানুল্লাহ খানের প্রগতিশীল সংস্কার এবং তার পতনের প্রেক্ষাপট তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করেছেন।
•দার্শনিকতাঃ সৈয়দ মুজতবা আলী রচনায় আমরা দেখতে পাই-তার লেখায় জীবন, সমাজ ও মানুষের আচরণ সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ ও দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ। যে প্রকাশে তিনি শুধু ঘটনার বর্ণনা দেননি, ঘটনার পেছনের কারণ ও তাৎপর্য নিয়েও অতি সুক্ষ নিপুণ দৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।আর সেখানে-
•পর্যবেক্ষণশীলতাঃ মুজতবা আলী ছিলেন একজন বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক। আফগানিস্তানের মানুষের জীবনযাপন, তাদের চালচলন, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, এমনকি তাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত তিনি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন, যা তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচায়ক।
৩) বর্ণময়তাঃ সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশ-বিদেশ' রচনাটি সরসত, মেধা পাণ্ডিত্য এবং বর্ণময়তায় রচনাটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে। আর সেই দৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই-
•অপরূপ চিত্ররূপময়তাঃ মুজতবা আলী তার রচনাটিতে বর্ণনা এতটাই জীবন্ত করে তুলেছেন যে, পাঠকের মনে কাবুলের অলিগলি, পাহাড়, মানুষজন, সবকিছুই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আসলে সৈয়দ মুজতবা আলী শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতে পারতেন। আর সে ছবিগুলির -
•বিচিত্র বর্ণময় বিষয়ঃ দেশ বিদেশ রচনাটি শুধুমাত্র ভ্রমণকাহিনী নয়, এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাজনীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিদেশি শক্তির প্রভাব, এবং সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র। এই বিচিত্র বিষয়বস্তু রচনার বর্ণময়তা বাড়িয়েছে।
•ব্যক্তিত্বময় আবেগঃ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আবেগ: লেখক তার ব্যক্তিগত অনুভূতি, বিস্ময়, আনন্দ, এমনকি ভয়কেও অকপটে প্রকাশ করেছেন, যা রচনাটিকে আরও মানবিক এবং বর্ণময় করে তুলেছে। গৃহযুদ্ধের সময় তার কাবুল ত্যাগের বর্ণনা পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে।
•আড্ডার খোশমেজাজঃ মুজতবা আলীর লেখার ধরণ অনেকটা আড্ডার ঢং। আসলে গল্পগুলি তিনি পাঠককে বন্ধুর মতো পাশে বসিয়ে গল্প বলছেন, তথ্য দিচ্ছেন, বিশ্লেষণ করছেন। শুধু তাই নয়, আবার সেখানে তিনি নিজের মতামতও প্রকাশ করছেন। আর এই আড্ডার মেজাজ রচনাটিকে প্রাণবন্ত,রসময়,বর্ণময় করে তুলেছে।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সৈয়দ মুজতবা আলীর'দেশে বিদেশে' রচনাটি একটি স্বতন্ত্র লেখনশৈলীর এক আদর্শ নিদর্শন। তাই রচনাটি নিছক একটি ভ্রমণকাহিনী না হয়ে একটি সাংস্কৃতিক দলিলে রূপান্তরিত হয়েছে।আর সেই কারণেই গ্ৰন্থটি সামাজিক ভাষ্য এবং একটি মননশীল রচনা হয়ে উঠেছে। তবে লেখকের সরস উপস্থাপনা, গভীর মেধা ও পাণ্ডিত্য, এবং চিত্ররূপময় বর্ণনার গুণে দেশ বিদেশ রচনাটি বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে কালজয়ী রচনা, প্রাসঙ্গিক ও জনপ্রিয় সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত।
Comments
Post a Comment