১৯৪৬ দাঙ্গা রাজনীতির(6thSem) ট্র্যাজেডি বাংলা ছোটগল্পের পরিসরে কিভাবে এসেছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি রচনা অবলম্বনে তা আলোচনা করো।
১৯৪৬ দাঙ্গা রাজনীতির ট্র্যাজেডি বাংলা ছোটগল্পের পরিসরে কিভাবে এসেছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি রচনা অবলম্বনে তা আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ষষ্ঠ সেমিস্টার বাংলা অনার্স)
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা, যা 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' বা 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' নামে পরিচিত।আর সেটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ভয়াবহ রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি তৎকালীন সমাজ ও মানুষের মনে যে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, তা ছোটগল্পের মাধ্যমে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে ফুটে উঠেছে। আর সেই আলোচনা কয়েকটি ছোটগল্পের আলোকে আমরা নিম্নে তুলে ধরলাম। সেই আলোকে সেখানে আমরা দেখি-
১৯৪৬ সালের দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্পগুলোর মধ্যে সমরেশ বসুর 'আদাব'অন্যতম। আসলে এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প এবং এর মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। গল্পে দাঙ্গার বিভীষিকা, অমানবিকতা এবং একই সাথে মানবপ্রেম ও সহানুভূতির এক অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে।আর সেখানে আমরা দেখি- • দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে আকস্মিক মানবিক সম্পর্কের জন্ম ও তার করুণ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে।তবে দাঙ্গার রাতে একজন হিন্দু সুতা মজুর এবং একজন মুসলিম মাঝি একটি ট্রামের সিটের নিচে আশ্রয় নেয়। তারা একে অপরকে চিনতে পারে না, কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাদের মধ্যে একটি মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখে, একে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত যখন তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ পায়, তারা জানতে পারে যে, তারা একে অপরের শত্রু নয়, বরং একই বিপদের শিকার। গল্পটির শেষে মাঝিকে যখন পুলিশ গুলি করে, তখন সুতা মজুর 'আদাব' বলে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এই 'আদাব' কেবল একটি সম্ভাষণ নয়, বরং মানবতা, ভালোবাসা এবং সহানুভূতির এক গভীর প্রকাশ। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই-
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'একটি গল্প' দাঙ্গার এক ভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। আর সেই গল্পটি দাঙ্গা-পীড়িত সমাজের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনকে চিত্রিত করে। আর সেখানে আমরা দেখতে পাই-
• দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর কীভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয়। গল্পটি একটি হিন্দু পরিবারের চোখে দাঙ্গার চিত্র তুলে ধরে। তারা প্রথমে দাঙ্গাকে দূর থেকে দেখে, কিন্তু ধীরে ধীরে তা তাদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। সাধারণ মানুষ কীভাবে বিভাজন ও ঘৃণার শিকার হয়, তার এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় এই গল্পে। দাঙ্গার কারণে যে অবিশ্বাস এবং ঘৃণা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে মানবিক সম্পর্কের ওপর আঘাত হানে।অন্যদিকে-
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' গল্পে দাঙ্গার পরবর্তী সময় এবং উদ্বাস্তুদের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। আর সেই দুর্দশা চিত্রে আমরা দেখি-
•ছোট বকুলপুরের যাত্রী গল্পে দাঙ্গার প্রত্যক্ষ প্রভাবের চেয়ে তার দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। দাঙ্গার ফলে গৃহহারা মানুষ কীভাবে নতুন জায়গায় গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই চালায়, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গল্পে দেখানো হয়েছে, দাঙ্গার পর জীবন কিভাবে নতুন এক অনিশ্চয়তার মুখে এসে দাঁড়ায়। এছাড়াও আমার আরও দেখতে পাই -
•হাসান হাফিজুর রহমানের 'দুধভাত' গল্পটি দাঙ্গার সময়কার নারী এবং শিশুদের অসহায়তাকে তুলে ধরা হয়েছে। আজ সেখানে আমরা দেখি-
এই গল্পে দাঙ্গার হিংসা ও বর্বরতার শিকার এক পরিবারের কাহিনী উঠে আসে। গল্পে একজন মায়ের চোখে দাঙ্গার ভয়াবহতা দেখা যায়। তিনি তার শিশুকে বাঁচাতে কতটা অসহায়, তা এই গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দাঙ্গার কারণে মানুষের জীবনযাত্রা কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, তার একটি করুণ চিত্র এই গল্পে পাওয়া যায়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,১৯৪৬ সালের দাঙ্গা ছিল আসলে একটি রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি।যা বাংলা ছোটগল্পের পরিসরে মানবিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।আর উপরোক্ত গল্পগুলোতে দাঙ্গার নৃশংসতা, বিভাজন, অবিশ্বাস এবং একই সাথে মানবিকতা ও সহানুভূতির এক অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে। লেখকরা রাজনৈতিক দাঙ্গার শিকার সাধারণ মানুষের অসহায়তা, তাদের জীবন-জীবিকার সংকট এবং মানবিক সম্পর্কের ভাঙন ও পুনর্গঠনকে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গল্পগুলো কেবল ইতিহাস নয়, বরং একটি অমানবিক সময়ের মানবিক দলিল এ তথ্য আমাদের স্বীকার করতেই হয়।
Comments
Post a Comment