Skip to main content

ফেরারি ফৌজ নাটকটি কোন শ্রেণীর নাটক? আলোচনা করো।

        ফেরারি ফৌজ নাটকটি কোন শ্রেণীর নাটক? আলোচনা করো।

           • আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,উৎপল দত্ত রচিত 'ফেরারী ফৌজ' নাটকটি মূলত একটি রাজনৈতিক বা বিপ্লবী নাটক। যে নাটকটি বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনবলা যেতে পারে।কারণ নাটকটিতে তৎকালীন সময়ে ঔপনিবেশিক ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক খণ্ড অধ্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে। আর এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে , ফেরারি ফৌজ নাটকটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা বিপ্লবী নাটক নয়, এটি একটি জাতীয়তাবোধের নাটক।সেই আলোকে আমরা দেখি-

রাজনৈতিক বা বিপ্লবী নাটক হিসেবে ফেরারি ফৌজঃআমরা জানি 'ফেরারী ফৌজ' নাটকটি ১৯৩০-এর দশকের অবিভক্ত পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বিপ্লবী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই সময়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন। উৎপল দত্ত তাঁর মার্কসবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, এবং তাদের আদর্শের উত্থান-পতনকে নাটকের মূল বিষয়বস্তু করেছেন। আর সেখানে তিনি বলেন-

'ফেরারি ফৌজ'didn't fail.ফেরারি ফৌজ ran pretty well-had packet houses।"

    তবে ফেরারি ফৌজ নাটকে বিপ্লবীরা তাদের নেতা শান্তি রায়ের নির্দেশে একের পর এক ইংরেজ হত্যার ব্রত গ্রহণ করে। নাটকের অন্যতম চরিত্র অশোক চাটুজ্যে  প্রশ্ন তোলে- '                                                                       এই হত্যাকান্ডের আবশ্যকতা কি? প্রয়োজন কি উদ্দেশ্য কি?

 আমরাতো একজন উইলমটকে মারলাম।তার জায়গায় আরেক পুলিশ সুপার আসবে। সে হবে উইলমটের চেয়েও হিংস্র, উন্মত্ত, নিষ্ঠুর। মেরে মেরে ইংরেজ রাজত্ব শেষ হবে?" এই সংলাপটি নাটকের বিপ্লবী সংগ্রামের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা বিপ্লবের আদর্শের দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তোলে।

•ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফেরারি ফৌজঃনাটকটি ১৯৩০-এর দশকের একেবারে গোড়ার দিকের স্বদেশি সশস্ত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হলেও, এর মধ্যে স্তালিন, বলশেভিকবাদ ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে উৎপল দত্ত অগ্নিযুগের এই বিপ্লব-প্রচেষ্টাকে মার্কসবাদী বিপ্লব-প্রচেষ্টা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।তবে নাট্যকার-

         উৎপল দত্ত তার এক সাক্ষাৎকারে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছেন: "ইতিহাসের পর্যালোচনা, মার্কসবাদী দৃষ্টিতে ইতিহাসকে না দেখলে পরে, মার্কসবাদী দৃষ্টিতে বর্তমানকেও দেখা যায় না। এটা আমরা বিশ্বাস করি এবং নাটকের একটা অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে অতীতকে সঠিকভাবে মার্কসবাদী আলোকে তুলে ধরা। কেননা, আগের সমস্ত বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানেরই ঐতিহ্য বহন করছে আজকের কমিউনিস্টরা।"

       আসলে এই নাটকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং জালালাবাদের সংগ্রামের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার প্রভাব দেখা যায়। পূর্ববঙ্গের মেঘনা নদী তীরবর্তী ভুবনডাঙ্গা গ্রামের শান্ত জীবনেও বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে।আর সেখানে আমরা দেখি- 

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রেণীসংগ্ৰামঃউৎপল দত্তের নাটকে সর্বদা শ্রেণীসংগ্রাম এবং রাজনৈতিক চেতনার প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। আর এক্ষেত্রে"ফেরারী ফৌজ"-ও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বিপ্লবীদের সংগ্রামকে শুধু স্বাধীনতার জন্য একটি লড়াই হিসেবে না দেখে, শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন। তবে-

   নাট্যকার উৎপল দত্ত রাজনৈতিক নাটকের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বলেছেন, "শুধুমাত্র প্রগতিশীল হওয়াটাই আজ আর যথেষ্ট নয়... অত্যাচার অনাচারের সামান্য সমালোচনামূলক আলেখ্য প্রদর্শন করে বুর্জোয়া ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজমের ঊর্ধ্বেও ওঠা যাবে না...এই মুহূর্তে প্রয়োজন রেভোলিউশনারি রিয়ালিজম-এর, বৈপ্লবিক বাস্তবতা প্রদর্শনের।" 

নাটকের চরিত্রায়নঃআলোচ্য নাটকে বিপ্লবীদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব, নেতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি টানাপোড়েন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।'জীবন সুন্দর'- এই ধরনের উদ্ধৃতি নাটকের বিপ্লবী এবং মানবিক দিকগুলির মধ্যে এক সূক্ষ্ম সংঘাত তৈরি করে। যেখানে-

            •নাটকের একেবারে শেষ দৃশ্যে যখন বিপ্লবী শান্তি তাঁর এক সময়ের প্রিয় শিষ্য অশোককে বলেন, "বিপ্লব করতে এসে কেন তোমার পরিবারের কথা মনে পড়বে? ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা পড়ার আগে কেন মৃত্যু বরণ করলে না? সায়ানাইড ছিল না?" তার উত্তরে অশোক স্রেফ একটাই কথা বলে-"বিকজ,লাইফ ইজ বিউটিফুল"এই সংলাপটি বিপ্লব ও জীবনের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে।(Ferari Fouj-Theatre Road)

দার্শনিক উৎপল দত্তঃনাট্যকার উৎপল দত্ত বিশ্বাস করতেন-"নাটক আমাদের কাছে একান্তভাবে একটি সামাজিক ক্রিয়া।" সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে যদি তাকে ধরতে হয় তবে প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন লক্ষ্য করার চোখ তৈরি করতে হয়। আর উৎপল দত্ত-র 'ফেরারী ফৌজ' ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের খণ্ড অধ্যায় - Anyalekho"এই নাটকে তিনি সেই সামাজিক ক্রিয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

            পরিশেষে "ফেরারী ফৌজ" একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বা বিপ্লবী নাটক, যা শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পুনর্নির্মাণ নয়, বরংবলা যায় সেই সময়ের বিপ্লবী আদর্শ, তার সীমাবদ্ধতা এবং শ্রেণীসংগ্রামের জটিলতাগুলিকেও তুলে ধরেছেন।তবে উৎপল দত্তের মার্কসবাদী চিন্তাধারা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা এই নাটককে এক স্বতন্ত্র মাত্রা দিয়েছে, যা এটিকে বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক কালজয়ী স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...