'আগুন পাখি' উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ষষ্ঠ সেমিস্টার বাংলা অনার্স)।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' (২০০৬) একটি অসাধারণ উপন্যাস, যা দেশভাগের পটভূমিতে রাঢ় বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক অসাধারণ চিত্র তুলে ধরে। এর নামকরণের পেছনে গভীর তাৎপর্য ও প্রতীকী অর্থ নিহিত রয়েছে।আর সেখানে আমরা দেখি-
•আগুন পাখি ফিনিক্স পাখির প্রতীকঃগ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির (Phoenix) কথা আমরা জানি, যা নিজের ভস্ম থেকে নতুন করে জন্ম নেয়। উপন্যাসের মূল নারী চরিত্র, যাকে কথক হিসেবে দেখানো হয়েছে, সে-ও যেন এক আগুনপাখি। দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা, ভিটেমাটি হারানোর বেদনা, এবং পরিবারের ভাঙন তাকে এক আগুনে পোড়ায়। তার স্বামী, সন্তান ও পরিজনেরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও, সে তার ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে থাকে।আসলে-
এই নারী চরিত্রটি যেন পোড়া মাটির মতোই দৃঢ়, যা সব প্রতিকূলতা সহ্য করেও নিজের অস্তিত্বের মাটিতেই থেকে যায়। তার এই মাটি আঁকড়ে থাকার জেদ, তার ভেতরকার দৃঢ়তা এবং আত্মশক্তিকে আগুনপাখি-র রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সে ভস্মস্তূপের মতো এক ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও নতুন করে বেঁচে থাকার সাহস দেখায়, যা ফিনিক্স পাখির পুনর্জন্মের ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
•আগুন পাখি দেশভাগের আগুনঃ আগুন পাখি উপন্যাসে দেশভাগের ফলে সৃষ্ট দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং গণপ্রব্রজনের ঘটনাকে 'আগুন' হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই আগুন শুধু ঘরবাড়ি বা সম্পত্তি পোড়ায়নি, বরং মানুষের সম্পর্ক, বিশ্বাস এবং জীবনকেও পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। কথক নারীটি তার সরল গ্রামীণ ভাষায় এই আগুনকে অনুভব করে, যদিও সে সরাসরি রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝে না। সে বলে- " সারা দেশের ভারি জ্বর হয়েছিল, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল,চোখ করমচার মত লাল...।"
আসলে এই 'জ্বর' বা 'আগুন' দেশভাগের তীব্র জ্বালা, যা তাকে এবং তার পরিবারকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। এই আগুন-এর মধ্যে দাঁড়িয়ে যে পাখিটি তার শেকড় আঁকড়ে ধরেছিল, সে-ই হলো এই নারী, যা উপন্যাসের নামের সঙ্গে এক গভীর সংযোগ তৈরি করে।
•আগুন পাখি নারীর ভেতরের আগুনঃ আগুন পাখি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন নিরক্ষর, গ্রাম্য নারী। তার জীবন ছিল সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু দেশভাগের মতো এক বিশাল রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার মুখে তার ভেতরের শক্তি জেগে ওঠে। তার স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা যখন দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে একা হয়েও নিজের জন্মভূমি ছাড়তে রাজি হয় না। তার এই আপসহীন সিদ্ধান্ত তার ভেতরের এক অজেয় আগুন-এরই বহিঃপ্রকাশ। এই আগুন তার আত্মমর্যাদা, মাটির প্রতি ভালোবাসা এবং তার নিজস্ব অস্তিত্বের প্রতীক। সে তার স্বামীকে বলে, "একটা বড় বৃক্ষকে যদি তার ভূমি থেকে তুলে নিয়ে অন্যভূমিতে রোপণ করা হয় তবে সে বৃক্ষ বাঁচবে না।" তার এই কথাগুলো শুধু তার একার নয়, বরং সেই সব মানুষের, যারা দেশভাগের শিকার হয়েও নিজেদের শেকড় ছাড়তে রাজি ছিল না।
•আগুন পাখি ভাষার স্বকীয়তাঃআগুন পাখি উপন্যাসের ভাষা রাঢ় বাংলার গ্রামীণ কথ্যভাষা, যা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কথক নারীটির অমার্জিত এবং সরল ভাষায় দেশভাগের মতো একটি জটিল বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। এই ভাষা যেন এক তীব্র অগ্নিশিখা, যা সরাসরি পাঠকের মনে দাগ কাটে। এই ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে লেখক প্রমাণ করেন যে, দেশভাগের মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত যন্ত্রণার দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা সম্ভব।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,'আগুনপাখি' উপন্যাসের নামকরণ তাই কেবল একটি নাম নয়, বরং একটি প্রতীক। এটি দেশভাগের বিধ্বংসী আগুন, এই আগুনে দগ্ধ হয়েও জন্মভূমিকে আঁকড়ে ধরে থাকা অজেয় নারীশক্তি, এবং ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে জেগে ওঠার এক মহাকাব্যিক আখ্যানকে তুলে ধরে। এই নামকরণের মাধ্যমেই হাসান আজিজুল হক দেশভাগের যন্ত্রণাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছেন, যা উপন্যাসটিকে আরও বেশি সার্থককরে তুলেছে এ তথ্য স্বীকার্য।
Comments
Post a Comment