Skip to main content

অশনি সংকেত উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা কতখানি শিল্পসার্থক হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করো।

'অশনি সংকেত' উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা কতখানি শিল্পসার্থক হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ষষ্ঠ সেমিস্টার বাংলা অনার্স)


             আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম একটি উপন্যাস 'অশনি সংকেত'। আর এই দৃষ্টিতে আমরা বলতে পারি বিভূতিভূষণবন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশনিসংকেত'    উপন্যাসের নামকরণটি নিঃসন্দেহে শিল্পসার্থক এবং গভীর ব্যঞ্জনাময়। আর সেই শিল্প ও ব্যঞ্জনাময়ের মাধ্যমে এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু, আবহ এবং পরিণতিকে অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। আর সেখানে দেখা যায় যে-

'অশনি সংকেত' শব্দবন্ধটির আক্ষরিক অর্থ হলো বজ্রপাতের পূর্বাভাস বা আসন্ন বিপদসঙ্কেত। আর উপন্যাসের এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিচার করলে দেখা যাবে যে, অশনি সংকেত এই নামকরণটি একাধিক স্তরে সার্থক হয়ে উঠেছে, তেমনিভাবে হয়ে উঠেছে গভীর ব্যঞ্জনাময়। আর সেই ব্যঞ্জনময় পরিবেশে উঠে এসেছে-

     দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসঃ আমরা জানি উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তর।যে মন্বন্তর ছিল এক মানবসৃষ্ট মহাবিপর্যয়।যে বিপর্যয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের ভুল নীতি, খাদ্য মজুতদারি, এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার ফলে বাংলায় এক ভয়াবহ খাদ্যাভাব দেখা দেয়।আর-

       'অশনি সংকেত'ঠিক সেই আসন্ন দুর্ভিক্ষেরই এক ঘোরতর পূর্বাভাস। উপন্যাসটি শুরু হয় গ্রামের সাধারণ জীবনের শান্ত সরল চিত্র দিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জীবনের ওপর দুর্ভিক্ষের যে কালো ছায়া নেমে আসে।যে ছায়া বজ্রপাতের পূর্ববর্তী গুমোট পরিবেশের মতোই। তবে গ্রামের মানুষ প্রথমে এই বিপদকে সেভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি, যেমন বজ্রপাত হওয়ার আগে মেঘের গর্জন বা বিদ্যুতের ঝলকানিকে অনেকে বিপদ সংকেত হিসেবে দেখে না। কিন্তু বিপদ যখন ঘনীভূত হয়, তখন তা আর এড়ানো সম্ভব হয় না।

        প্রকৃতির ভূমিকাঃ বিভূতিভূষণ তাঁর উপন্যাসে প্রকৃতিকে এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ করে তুলে ধরেছেন। আর সেখানে উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি,প্রকৃতির স্নিগ্ধ, শান্ত ও সজীব বর্ণনা রয়েছে। গ্রামের পুকুর, বাঁশবন, পেঁপে গাছ, কুমড়োর লতা - সবকিছুই এক গ্রামীণ সজীবতার ছবি তুলে ধরে। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃতির এই শান্ত রূপও যেন দুর্ভিক্ষের আঁচড়ে কদর্য, বিকৃত ও রুক্ষ হয়ে ওঠে। আসলে 'অশনি সংকেত'নামটি যেন প্রকৃতির এই নীরব অথচ আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত। একসময় যে প্রকৃতি জীবন ধারণের উৎস ছিল, আর সেই প্রকৃতি আজ যেন সময় মহাবিপর্যয়ের আগাম বার্তা নিয়ে আসে। আর সেখানে -

       মূল্যবোধের অবক্ষয়ঃ সেদিন দুর্ভিক্ষের ফলে শুধু খাদ্যের অভাবই দেখা দেয়নি, তার সঙ্গে ঘটেছিল মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। ক্ষুধা মানুষকে এতটাই অসহায় করে তুলেছিল যে, ধর্ম, জাতিভেদ, সামাজিক রীতিনীতি - সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে। মানুষ তার নিজের গোঁড়ামি, আত্মম্ভরিতা, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে কেবল টিকে থাকার জন্য লড়তে শুরু করে। এই সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ও এক বড় 'অশনিসংকেত'। সেই সংকেত  উপন্যাসে গভীর ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে। গঙ্গাচরণের মতো ব্রাহ্মণও নিজের সংস্কার ত্যাগ করে মৃত মুচিনীর সৎকার করতে বাধ্য হয়। যা এই মানবিক অবক্ষয় এবং নতুন মূল্যবোধের উত্থানের এক স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।তবে-

       ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা অশনি সংকেতঃ আমরা জানি যে,১৯৪৩ সালের মন্বন্তর ছিল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।আর সেই অধ্যায়ে 'অশনি সংকেত' শুধু সেই সময়ের বাস্তব চিত্রই তুলে ধরে না, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্কবাণীও বটে। আসলে উপন্যাসটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয় কিভাবে এক বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে এবং সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে, তার এক মর্মস্পর্শী দলিল। তাই নামটি যেন মানবজাতিকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি দায়িত্বহীনতা কিভাবে মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে। সুতরাং-

              •পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, উপন্যাসের 'অশনি সংকেত' নামটি নিছক একটি প্রতীকী নাম নয়, এটি উপন্যাসের মূল ভাব, চরিত্রগুলির পরিণতি, তৎকালীন সমাজের অস্থিরতা এবং প্রকৃতির পরিবর্তনশীল রূপকে অত্যন্ত সফলভাবে প্রতিফলিত করে। শুধু তাই নয়,এটি পাঠককে উপন্যাসের গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং মন্বন্তরের ভয়াবহতা ও তার বহুমুখী প্রভাব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়। আর এই নামকরণের মাধ্যমেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনিবার্য ধ্বংস ও মানব সমাজের গভীর সংকটের বিষয়টি প্রবল দক্ষতার সাথে চিত্রাঙ্কন করেছেন।

   •• ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ(Samaresh Sardar)এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏 ।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...