আমরা জানি যে শিক্ষায় মূল্যায়ণের কৌশলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর অগ্রগতি, দুর্বলতা এবং শিখনের কার্যকারিতা সঠিকভাবে নির্ণয় করা। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রচলিত মূল্যায়ন কৌশল নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।আর সেখানে আমরা দেখি-
শিক্ষা বিজ্ঞানে মূল্যায়ণকে সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়- ১) গঠনমূলক মূল্যায়ন । । ২)সমষ্টিগত মূল্যায়ন। আর এই দুই ধরনের মূল্যায়নের জন্য যে সকল কৌশল গুলি ব্যবহার করা হয় সেগুলি হলো-
গঠনমূলক মূল্যায়ন (Formative Evaluation) এবং সমষ্টিনির্ভর মূল্যায়ন (Summative Evaluation)। এই দুই ধরনের মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়।
১)গঠনমূলক মূল্যায়ন (Formative Evaluation)
এটি শিক্ষার প্রক্রিয়া চলাকালীন করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা, তাদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা এবং তাদের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া।
•শ্রেণীকক্ষে পর্যবেক্ষণঃ শিক্ষক সরাসরি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের আচরণ, অংশগ্রহণ, এবং শিখনের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন শিক্ষার্থীরা কীভাবে শিখছে, তাদের মনোযোগ কেমন এবং কোন বিষয়ে তাদের অসুবিধা হচ্ছে।
•প্রশ্নোত্তর পর্বঃক্লাসের মধ্যে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করে তাদের ধারণার স্পষ্টতা পরীক্ষা করতে পারেন। এটি মৌখিক হতে পারে, যেখানে ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দেয়, অথবা লিখিত হতে পারে।যেমন: কুইজ।
•কুইজ ও ছোট পরীক্ষাঃ কোনো একটি পাঠ বা অধ্যায় শেষ হওয়ার পর দ্রুত কুইজ নেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষক বুঝতে পারেন শিক্ষার্থীরা মূল বিষয়বস্তু কতটা বুঝতে পেরেছে।
বাড়ির কাজ ও অ্যাসাইনমেন্টঃ শিক্ষার্থীরা বাড়ির কাজ বা অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে যা শিখেছে, তা প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। শিক্ষকের দেওয়া ফিডব্যাক তাদের ভুল সংশোধন করতে সাহায্য করে।
সেলফ অ্যাসেসমেন্টঃ শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজ নিজেরাই মূল্যায়ন করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করতে এবং শিখনের দায়িত্ব নিতে শেখে।
* পিয়ার অ্যাসেসমেন্ট (Peer Assessment): শিক্ষার্থীরা একে অপরের কাজ মূল্যায়ন করে। এতে তারা সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে এবং গঠনমূলক মতামত দিতে শেখে। এটি তাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা তৈরিতে সাহায্য করে।
* পোর্টফোলিও (Portfolios): এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীর কাজের একটি সংগ্রহ। এতে তার বিভিন্ন ধরনের কাজ (যেমন: প্রবন্ধ, প্রকল্প, চিত্র, নোট ইত্যাদি) জমা থাকে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি, সৃজনশীলতা এবং প্রচেষ্টা বোঝা যায়।
২. সমষ্টিনির্ভর মূল্যায়ন (Summative Evaluation)
এটি একটি শিক্ষাক্রম, কোর্স, বা শিক্ষাবর্ষের শেষে করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর সামগ্রিক পারদর্শিতা বিচার করা এবং তাকে একটি গ্রেড বা সার্টিফিকেট প্রদান করা।
* লিখিত পরীক্ষা (Written Examinations): এটি সবচেয়ে প্রচলিত কৌশল। এর মধ্যে বহু-নির্বাচনী (MCQ), সংক্ষিপ্ত উত্তর, এবং রচনাধর্মী প্রশ্ন থাকতে পারে।
* নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা (Objective Tests): এই ধরনের পরীক্ষায় সঠিক উত্তরের একটি নির্দিষ্ট রূপ থাকে, যেমন—MCQ, শূন্যস্থান পূরণ, সত্য/মিথ্যা নির্ণয় ইত্যাদি।
* রচনাধর্মী পরীক্ষা (Essay-Type Tests): এই পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীরতা প্রকাশ করতে পারে।
* মৌখিক পরীক্ষা (Oral Examinations/Viva-Voce): এই পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মৌখিক দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর জ্ঞান যাচাই করা হয়।
* পারফরম্যান্স-ভিত্তিক মূল্যায়ন (Performance-Based Assessment): এই কৌশলটি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে কোনো কাজ করে তাদের দক্ষতা প্রমাণ করে। যেমন—বিজ্ঞান প্রজেক্ট, উপস্থাপনা, নাট্য প্রদর্শন, বা ব্যবহারিক পরীক্ষা।
* প্রজেক্ট ও গবেষণা (Projects and Research): শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে গভীর গবেষণা করে একটি প্রজেক্ট বা রিপোর্ট তৈরি করতে দেওয়া হয়। এতে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার, তথ্য সংগ্রহ করার এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা যাচাই করা হয়।
* ডায়াগনস্টিক অ্যাসেসমেন্ট (Diagnostic Assessment): এটি শিক্ষার্থীদের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দুর্বলতার কারণ নির্ণয় করতে সাহায্য করে। এটি সাধারণত শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে বা কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার সময় ব্যবহার করা হয়।
একটি কার্যকর মূল্যায়ন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
একটি ভালো মূল্যায়ন কৌশলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত:
* বৈধতা (Validity): মূল্যায়ন পদ্ধতিটি যা মাপতে চায়, তা সঠিকভাবে পরিমাপ করছে কি না।
* নির্ভরযোগ্যতা (Reliability): একই পরিস্থিতিতে বারবার মূল্যায়ন করলে একই ফল পাওয়া যায় কি না।
* স্বচ্ছতা (Transparency): মূল্যায়নের মানদণ্ড এবং পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট ও বোধগম্য হতে হবে।
* ন্যায়পরায়ণতা (Fairness): মূল্যায়ন পদ্ধতিটি যেন সকল শিক্ষার্থীর জন্য সমান ও পক্ষপাতহীন হয়।
* সাদৃশ্যতা (Authenticity): বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা।
মূল্যায়নের সঠিক কৌশল নির্বাচন করা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উভয়ের জন্যই অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি কেবল ফলাফল জানার একটি উপায় নয়, বরং শিখনের প্রক্রিয়াকে উন্নত করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
Comments
Post a Comment