Skip to main content

দ্রব্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদীদের2 মতামত সবিচার আলোচনা করো।

দ্রব্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদীদের মতামত সবিচার আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার, দর্শন মাইনর)।

বুদ্ধিবাদীরা যেখানে যুক্তির মাধ্যমে দ্রব্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন, অভিজ্ঞতাবাদীরা সেখানে অভিজ্ঞতার ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, জ্ঞান ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকেই আসে। তাই, যে জিনিসের সরাসরি অভিজ্ঞতা হয় না, তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন।এই ধারার প্রধান তিন দার্শনিক হলেন-জন লক,জর্জ বার্কলে এবং ডেভিড হিউম।আর সেখানে দেখি-

জন লকের মতে দ্রব্যঃ লকের মতে, আমাদের সব ধারণা আসে সংবেদন ও প্রতিফলন থেকে।আমরা কোনো বস্তুকে দেখি, তার রঙ, আকার, গন্ধ অনুভব করি। এই গুণগুলো হলো গুণাবলী। লক এই গুণগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেন-                            ১) মুখ্য গুণ                                                                       ২) গৌণ গুণ।

       •  মুখ্য গুণ  বস্তুর নিজস্ব গুণ, যা বস্তুর বাইরেও বিদ্যমান থাকে, যেমন—আয়তন, আকার, সংখ্যা, গতি ইত্যাদি। এগুলি বস্তু থেকে অবিচ্ছেদ্য। আর-

     • গৌণ গুণ বস্তুর এমন গুণ, যা বস্তুর ভেতরে থাকে না, বরং আমাদের সংবেদনশীল অঙ্গের ওপর বস্তুর প্রভাবে সৃষ্টি হয়, যেমন—রঙ, গন্ধ, স্বাদ, শব্দ।

            •লক আরোও বলেন-আমরা কোনো বস্তুর শুধু গুণগুলোই (যেমন—রঙ, আকার, ওজন) অনুভব করি। কিন্তু এই গুণগুলো যার উপর নির্ভর করে থাকে, সেই আশ্রয় বা আধার কে আমরা সরাসরি উপলব্ধি করতে পারি না। তিনি এই আশ্রয়কেই "দ্রব্য" বলেছেন। তার মতে, দ্রব্য হলো এমন একটি অজানা আধার, যা গুণগুলোকে ধারণ করে। এটি একটি "কিছু একটা,যা আমরা জানি না"।

সমালোচনাঃলকের এই মতবাদের বিরুদ্ধে বড় সমালোচনা হলো, তিনি এক প্রকার অজ্ঞেয়বাদ (Agnosticism)-এর দিকে চলে যান। যদি দ্রব্যকে কোনোভাবেই জানা না যায়, তাহলে তার অস্তিত্ব আছে কি না, তা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়? তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে, দ্রব্যের ধারণাটি অপরিষ্কার এবং অস্পষ্ট। এই ত্রুটি পরবর্তী অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের হাতে আরও বেশি সমালোচিত হয়।

•জর্জ বার্কলে মতে দ্রব্য 

বার্কলে লকের মতবাদকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি লকের মুখ্য ও গৌণ গুণের বিভাজনকে বাতিল করে বলেন যে-"মুখ্য গুণগুলিও গৌণ গুণের মতোই আমাদের মনের ওপর নির্ভরশীল।" উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন- একটি বস্তুর আকার বা গতি আমাদের দৃষ্টি বা অবস্থানের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থাৎ, গুণাবলী বস্তু থেকে আলাদা করে দেখা যায় না, তারা আমাদের মনের ওপর নির্ভরশীল।

বার্কলের বিখ্যাত উক্তি হলো- "অস্তিত্ব মানেই হলো অনুভূত হওয়া। ("Esse est percipi")। আসলে তাঁর মতে, বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে তার অনুভূত হওয়ার ওপর। যদি কেউ কোনো বস্তুকে উপলব্ধি না করে, তবে তার অস্তিত্ব নেই। তাহলে, যখন আমরা কোনো বস্তুকে দেখি না, তখন কি সেটির অস্তিত্ব থাকে না? বার্কলে এর উত্তরে বলেন যে, বস্তু আমাদের মনের দ্বারা অনুভূত না হলেও ঈশ্বরের মনে সেটি সবসময় অনুভূত হয়। ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ এবং সর্বব্যাপী, তাই তার মন সব বস্তুকে সর্বদা উপলব্ধি করে।

বার্কলে দ্রব্যের অস্তিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তার মতে, দ্রব্য বলতে মন বা আত্মার মতো কোনো চিন্তনশীল দ্রব্য (Thinking Substance) ছাড়া আর কিছু নেই। বস্তুগত দ্রব্য বলতে যা বোঝানো হয়, তা কেবল গুণাবলীর একটি গুচ্ছ (bundle of qualities) মাত্র, যার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই।

সমালোচনাঃবার্কলে মতবাদের প্রধান সমালোচনা হলো, এটি আমাদের সাধারণ বুদ্ধি এবং বাস্তবের ধারণার পরিপন্থী। তার মতবাদ অনুসারে, কোনো বস্তু যদি কেউ না দেখে, তাহলে তার অস্তিত্ব থাকে না—এই ধারণাটি অযৌক্তিক মনে হয়। যদিও তিনি ঈশ্বরের ধারণাকে এর সমাধান হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তবুও এটি বস্তুর বাস্তবতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে একটি ভাববাদী (Idealist) অবস্থান গ্রহণ করে। এর ফলে বস্তুর জগতে শৃঙ্খলা ও কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ডেভিড হিমের মতে দ্রব্য

হিউম অভিজ্ঞতাবাদের চরম সীমায় পৌঁছে যান। তিনি লক এবং বার্কলির যুক্তির ওপর ভিত্তি করে দ্রব্যের ধারণাটিকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেন। হিউমের মতে-"আমাদের মন হলো ধারণা এবং মুদ্রণ এর একটি সমষ্টি"।তবে  আমরা যখন কোনো বস্তুকে দেখি, তখন আমরা কেবল তার বিভিন্ন গুণের মুদ্রণ পাই (যেমন—লাল রঙ, গোলাকার আকার, শক্ত স্পর্শ)। এই মুদ্রণগুলো একত্রিত হয়ে আমাদের মনে একটি ধারণা তৈরি করে।

হিউম আরও বলেন যে, আমরা কখনোই এই গুণগুলোর বাইরে কোনো স্থায়ী আধার বা দ্রব্যের মুদ্রণ পাই না। অর্থাৎ, আমরা কেবল ধারণার গুচ্ছকে পাই, কিন্তু এই গুচ্ছকে ধারণ করার জন্য কোনো দ্রব্যের অভিজ্ঞতা আমাদের হয় না।

          আসলে হিউমের মতে, দ্রব্য হলো একটি কাল্পনিক ধারণা, যা আমাদের অভ্যাস এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা থেকে তৈরি হয়। আমরা বারবার যখন কিছু গুণাবলীকে একসাথে দেখি (যেমন, একটি আপেলের রঙ, গন্ধ, স্বাদ), তখন আমরা মনে করি যে এই গুণগুলোর পেছনে একটি স্থায়ী সত্তা আছে, যার নাম 'আপেল'। কিন্তু এটি কেবল একটি মানসিক প্রবণতা, কোনো বাস্তব সত্তা নয়।

সমালোচনাঃহিউমের এই মতবাদ অতিমাত্রায় সংশয়বাদী এর প্রধান সমালোচনাগুলো হলো-

 বস্তুর অস্তিত্ব সংশয়ঃ হিউম যদি দ্রব্যের ধারণাকে বাতিল করেন, তাহলে বাস্তব জগতের বস্তুর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদি টেবিল, চেয়ার বা মানুষ কেবল ধারণার গুচ্ছ হয়, তবে তাদের স্থিতিশীলতা এবং বাস্তবতার কোনো ভিত্তি থাকে না।

 আত্মার অস্তিত্ব সংশয়ঃ হিউম বস্তুজগৎ-এর দ্রব্যের পাশাপাশি আত্মার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করেন। তার মতে, 'আত্মা' হলো কেবল মানসিক অবস্থা বা ধারণার একটি প্রবাহ। এর কোনো স্থায়ী সত্তা নেই।

কার্যকারণ সংশয়ঃঃ হিউম দ্রব্যের মতোই কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণাটিও বাতিল করেন। এতে বিজ্ঞানের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়, যা বাস্তব জগৎকে কার্যকারণ শৃঙ্খলার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,বুদ্ধিবাদী দার্শনিকরা যেখানে যুক্তির মাধ্যমে দ্রব্যের অনিবার্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, অভিজ্ঞতাবাদীরা সেখানে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দ্রব্যের ধারণাকে দুর্বল এবং অস্পষ্ট বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। লক যেখানে দ্রব্যকে একটি অজানা আধার হিসেবে রেখেছিলেন, বার্কলে সেখানে তাকে মন বা চেতনায় সীমাবদ্ধ করেন এবং হিউম সেই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেন। অভিজ্ঞতাবাদীদের এই সমালোচনা আধুনিক দর্শনে অধিবিদ্যা এবং জ্ঞানতত্ত্ব এর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাদের এই সংশয়বাদী অবস্থান পরবর্তী দার্শনিক, বিশেষ করে ইমানুয়েল কান্টকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

Comments

Popular posts from this blog

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...