অভিসার পর্যায়ের পদে কাব্য সৌন্দর্য বিচার করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার, বাংলা মেজর)।
•আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বৈষ্ণব পদাবলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো 'অভিসার'।আর এই পর্যায়ের পদে রাধা বা নায়িকা তাঁর প্রিয়তমের (কৃষ্ণ) সাথে মিলিত হওয়ার জন্য দুর্গম পথ অতিক্রম করে যাওয়ার প্রস্তুতি ও যাত্রা বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই প্রেক্ষিতে অভিসার পর্যায়ের কাব্য সৌন্দর্য বিচার করতে গেলে কিছু মূল দিক আলোচনা করা আমাদের প্রয়োজন।
•চিত্রধর্মিতা ও বর্ণনার নৈপুণ্যঃ অভিসার পর্যায়ের পদগুলিতে কবিরা অত্যন্ত নিপুণভাবে রাধার অভিসার যাত্রাপথের চিত্র অঙ্কন করেছেন। সেই অভিসার যাত্রাপথে আছে-অন্ধকার রাত, কণ্টকাকীর্ণ পথ, ঝড়-বৃষ্টি, বিদ্যুতের ঝলকানি, সর্পভীতি - এই সমস্ত প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে অত্যন্ত জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়। সেখানে গোবিন্দদাসের পদে দেখি-
"কন্ঠক গাড়ি কমল সম পদতল। মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।।"
এখানে রাধার কোমল পায়ের সঙ্গে কাঁটার উপমা এবং নুপুর ঢেকে যাওয়ার বর্ণনা চিত্রধর্মিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বর্ণনাগুলি পাঠক বা শ্রোতার মনে একটি স্পষ্ট চিত্র তৈরি করে।
•মানবিক দৃঢ়তা ও প্রেমের পরাকাষ্ঠাঃবাহ্যিক প্রতিকূলতার পাশাপাশি রাধার মানসিক দৃঢ়তা এই পর্যায়ের কাব্য সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। গুরুজনদের নিষেধ, সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়, প্রাকৃতিক বিপদ - কোনো কিছুই রাধাকে তার অভীষ্ট থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। তার এই অদম্য প্রেমই তাকে সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে শক্তি যোগায়। "কুল মরিয়াদ কপাট উদঘাঁটলু। তাহে কি কাটলি বাধা।।"
কবিদের এই সকল পংক্তি গুলি রাধার প্রেমের গভীরতা ও আত্মমর্যাদাবোধের পরাকাষ্ঠা প্রমাণ করে।
•প্রতীকী ব্যঞ্জনা ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যঃঅভিসার পর্যায়ের পদে শুধু বাহ্যিক প্রেমের চিত্রই থাকে না, এর গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে। রাধার কৃষ্ণমুখী যাত্রা আত্মিক মিলন বা ভগবৎ প্রাপ্তির প্রতীক। জাগতিক সুখ-দুঃখ, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে সাধনা, অভিসার পদাবলীতে তা চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। এটি ভক্তের পরমাত্মার প্রতি অবিচল ভক্তি ও ত্যাগের এক সুন্দর রূপক।
•ছন্দ ও অলংকারঃ বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যান্য পর্যায়ের মতো অভিসার পর্যায়ের পদগুলিতেও ছন্দ এবং অলংকারের ব্যবহার অসাধারণ। অনুপ্রাস, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি অলংকার পদগুলিকে শ্রুতিমধুর ও ভাবঘন করে তোলে। গোবিন্দদাসের পদগুলিতে ধ্বনিমাধুর্য এবং শব্দচয়নের বিশেষত্ব লক্ষণীয়, যা পদগুলিকে এক ভিন্ন মাত্রা দান করে।
•নাটকীয়তাঃবেশ কিছু অভিসার পদে এক ধরনের নাটকীয়তা লক্ষ্য করা যায়। রাধার প্রস্তুতির সময় তার দ্বিধা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বর্ণনা, এবং অবশেষে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে প্রিয়তমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা – এই সব কিছু মিলে এক অসাধারণ নাটকীয় পরিবেশ তৈরি হয়।
•কবিদের কবি কৃতিত্বঃঅভিসার পর্যায়ের পদ রচনায় গোবিন্দদাস বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। বিদ্যাপতিও এই পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন, তবে গোবিন্দদাসের পদে বৈচিত্র্য, চিত্রধর্মিতা এবং গভীরতা তুলনামূলকভাবে বেশি। গোবিন্দদাস কেবল শব্দবিন্যাস বা কাব্য সৌন্দর্যের দিক দিয়েই নয়, গভীর আধ্যাত্মিক সাধনার স্বচ্ছতা ও লীলার সংরাগে তাঁর অভিসারের কবিতাগুলিকে বৈষ্ণব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত করেছেন।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,অভিসার পর্যায়ের কাব্য সৌন্দর্য নিহিত আছে এর চিত্রধর্মী বর্ণনা, প্রেমের অদম্য শক্তি, আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা, সুন্দর ছন্দ ও অলংকার প্রয়োগ এবং সামগ্রিক নাটকীয়তায়। এটি শুধু রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার বর্ণনা নয়, বরং মানবাত্মার পরমাত্মার প্রতি অমোঘ আকর্ষণের এক চিরন্তন গাথা।
Comments
Post a Comment