পৌরাণিক নাটক কাকে(4th Semester Major)বলে? একটি সার্থক পৌরাণিক নাটকের পরিচয় দাও। পৌরাণিক নাটকের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ কি আলোচনা করো।
পৌরাণিক নাটক কাকে বলে ? একটি স্বার্থক পৌরাণিক নাটকের পরিচয় দাও। পৌরাণিক নাটকের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা মেজর)।
পৌরাণিক নাটকঃ আমরা জানি যে,পৌরাণিক নাটক হলো এমন এক নাটক যা সুপ্রাচীন পুরাণ, কিংবদন্তি বা ধর্মগ্রন্থ থেকে কাহিনী ও চরিত্র গ্রহণ করে রচিত হয়। শুধু তাই নয়,এই নাটকে সাধারণত দেব-দেবী, ঋষি-মুনি, রাজা-মহারাজা এবং পৌরাণিক বীরদের জীবন, কর্ম ও বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আবর্তিত হয়।আর সেখানে পৌরাণিক নাটকের মূল উদ্দেশ্য থাকে- ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধ প্রচার করা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং দর্শককে পৌরাণিক জগতে ডুবিয়ে দেওয়া।
•একটি সার্থক পৌরাণিক নাটক•
বিল্বমঙ্গলঃ আমরা জানি যে,কোন একটি নাটককে পৌরাণিক নাটকের পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে তার মধ্যে কিছু পৌরাণিক বিশেষত্ব থাকতে হয়। আর এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে,বাংলার নাট্যজগতে গিরিশচন্দ্র ঘোষের 'বিল্বমঙ্গল ঠাকুর (১৯০০) একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সার্থক পৌরাণিক নাটক হিসেবে বিবেচিত করা যায়। আর সেই পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে আমরা বিল্বমঙ্গল নাটকে দেখি-
বিল্বমঙ্গল নাটকে আধ্যাত্মিকতাঃ সার্থক পৌরাণিক নাটক কেবল গল্প বলা নয়, এর গভীরে থাকে এক উচ্চ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বার্তা। 'বিল্বমঙ্গল ঠাকুর' নাটকে ভক্তের ভগবানে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং বিষয়াসক্তি ত্যাগের মাধ্যমে ঈশ্বরপ্রাপ্তির গভীর আধ্যাত্মিক দিকটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।শুধু তাই নয়,এটি গিরিশচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় পৌরাণিক নাটক, যা ভক্ত বিল্বমঙ্গলের আধ্যাত্মিক যাত্রাকে কেন্দ্র করে রচিত।আর সেখানে-
চরিত্রের মহত্ত্ব ও মানবিকতাঃ দেব-দেবী বা পৌরাণিক চরিত্রগুলি প্রায়শই মহৎ এবং তাদের মধ্যে কিছু মানবিক দুর্বলতাও থাকে, যা তাদের আরও বাস্তবসম্মত করে তোলে। বিল্বমঙ্গল ঠাকুরের চরিত্রটি একজন বিষয়াসক্ত ব্যক্তি থেকে পরম ভক্তে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখানো হয়েছে।
ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষা ও সংলাপঃ পৌরাণিক নাটকের ভাষা সাধারণত আভিজাত্যপূর্ণ, কাব্যিক এবং গম্ভীর হয়। সংলাপগুলি চরিত্রগুলির মর্যাদা ও নাটকের আবহকে ফুটিয়ে তোলে। শুধু তাই নয়, এই নাটকে পৌরাণিক পরিবেশে বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য দৃষ্টিনন্দন সেট, পোশাক এবং আলোকসজ্জা অপরিহার্য। পাশাপাশি, ভক্তিপূর্ণ গান ও যন্ত্রসংগীত নাটকের আবেদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। 'বিল্বমঙ্গল ঠাকুর'-এর গানগুলি আজও দর্শকদের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
নাটকীয় সংঘাত ও পরিণতিঃ নাটকের মধ্যে সংঘাত থাকে, যা চরিত্রদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে এবং দর্শককে আকৃষ্ট করে রাখে। বিল্বমঙ্গলের জীবনে পতিতা চিন্তামণির প্রভাব, তার উপলব্ধি এবং ভক্তিপথে যাত্রার সংঘাতময় পরিণতি অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
•পৌরাণিক নাটকের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ•
আমরা জানি যে,একটা সময় বাংলা নাট্যমঞ্চে পৌরাণিক নাটকের বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। আর সেই জনপ্রিয়তা হ্রাসের কয়েকটি প্রধান কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
পরিবর্তিত রুচি ও আধুনিকতাঃআধুনিক দর্শক মূলত বাস্তবধর্মী এবং সামাজিক নাটকের প্রতি বেশি আগ্রহী। পৌরাণিক কাহিনীর অলৌকিকতা এবং ধর্মীয় আবেশ অনেক সময় বর্তমান দর্শকদের কাছে পুরনো বা অবাস্তব মনে হয়। দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষ আধুনিক সমস্যা ও জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে চায়।
•প্রযোজনার ব্যয় ও জটিলতাঃ পৌরাণিক নাটকের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল সেট, পোশাক, অলংকার এবং বিশেষ প্রভাবের প্রয়োজন হয়, যা ছোট বা নতুন নাট্যদল গুলির পক্ষে বহন করা কঠিন। এছাড়া, এই ধরনের নাটকের জন্য বিশেষ কুশীলব এবং নির্দেশনারও প্রয়োজন হয়।
•উপযুক্ত নাট্যকারের অভাবঃ বর্তমানে পৌরাণিক নাটক রচনার জন্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো প্রতিভাবান নাট্যকারদের অভাব দেখা যাচ্ছে। পৌরাণিক বিষয়বস্তুকে আধুনিক রুচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন করে উপস্থাপনের চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম নাট্যকারদের সংখ্যা কমে গেছে।
•চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের প্রভাবঃ চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনে পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে অনেক মেগাসিরিয়াল ও চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, যা ঘরে বসেই দেখার সুযোগ রয়েছে। এর ফলে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে পৌরাণিক নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে CGI-এর মাধ্যমে আরও সুনিপুণভাবে অলৌকিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব, যা মঞ্চে সীমিত।
•ধর্মনিরপেক্ষতাঃ ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের পুরাণকে কেন্দ্র করে নাটক নির্মাণ বা প্রদর্শন অনেক সময় বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে। কিছু দর্শক মনে করেন, পৌরাণিক নাটক ধর্মীয় গোঁড়ামি বা কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিতে পারে। সেই সাথে-
•বর্তমানে পোস্টমডার্ন, অ্যাবসার্ড, রাজনৈতিক থিয়েটার ইত্যাদি বিভিন্ন আধুনিক নাট্যরীতির আগমন ঘটেছে, যা দর্শকদের নতুন অভিজ্ঞতা প্রদান করছে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী পৌরাণিক নাটকের আবেদন কমে গেছে।
•সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার অভাবঃ অনেক সময় পৌরাণিক নাটকের বিষয়বস্তু বা বার্তা বর্তমান সমাজের সঙ্গে সরাসরি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না। আজকের জটিল সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানের দিশা এই ধরনের নাটকে খুঁজে পাওয়া যায় না বলে অনেক দর্শক মনে করেন।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,পৌরাণিক নাটক একসময় বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। যদিও বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা কমেছে, তবুও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য এবং পুরনো সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে এই ধরনের নাটকের প্রযোজনার প্রয়োজন রয়েছে।
Comments
Post a Comment