জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন মাইনর)।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক তত্ত্ব।যে তত্ত্বটি জেরেমি বেন্থামের উপযোগবাদের উপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছে। তবে তবে বেন্থামের উপযোগবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও বলা যায় যে,মিল এই তত্ত্বকে আরও পরিমার্জিত ও মনস্তত্ত্বসম্মত রূপ দিয়েছেন। আর সেখানে মিলের উপযোগবাদের মূলনীতিকে 'সর্বাধিক সুখের নীতি'(Greatest Happiness Principle) বলা হয়। আর সেই নীতির মূল কথা হলো-
কর্মের নৈতিক মানদন্ডঃ মিলের মতে, কোনো কাজ তখনই নৈতিকভাবে সঠিক, যখন সেটি সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ বা আনন্দ উৎপাদন করে। পক্ষান্তরে, যে কাজ দুঃখ বা আনন্দের বিপরীত ফল উৎপন্ন করে, তা অনৈতিক।
সুখের গুণগত পার্থক্যঃ সুখের গুণগত পার্থক্য: বেন্থাম কেবল সুখের পরিমাণগত তারতম্য স্বীকার করলেও, মিল সুখের গুণগত পার্থক্য (qualitative difference) এর ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সব ধরনের সুখ সমান নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক, আত্মিক এবং নৈতিক সুখ (যেমন জ্ঞানার্জন, শিল্প উপভোগ, মানবপ্রেম) দৈহিক বা ইন্দ্রিয়জাত সুখের (যেমন খাওয়া, পান করা) চেয়ে গুণগতভাবে উচ্চতর। মিল বলেন- একজন সন্তুষ্ট শূকর হওয়ার চেয়ে একজন অসন্তুষ্ট মানুষ হওয়া ভালো;একজন সন্তুষ্ট মূর্খ হওয়া চেয়ে একজন অসন্তুষ্ট সক্রেটিস হওয়া ভালো।""
অর্থাৎ যার অর্থ হলো, উচ্চতর সুখের অভিজ্ঞতা অর্জন করা কম সুখকর হলেও তা নিম্নতর সুখের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
মানুষের মর্যাদাঃ মিল মনে করতেন, মানুষের মধ্যে উচ্চতর ক্ষমতা আছে, যা তাদেরকে কেবল ইন্দ্রিয় সুখের ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সুখ অন্বেষণ করতে শেখায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে অন্যান্য ইন্দ্রিয় সর্বস্ব প্রাণী থেকে আলাদা করে।
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণঃ মিল উপযোগবাদকে সমর্থন করার জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় ধরনের নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন।আর সেখানে-
বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ হলো-সমাজের চাপ, আইন, সামাজিক নিয়মকানুন এবং প্রাকৃতিক পরিণতি, যা মানুষকে পরোপকারী হতে উৎসাহিত করে। যেমন, আইন ভাঙলে শাস্তির ভয় বা সমাজে খারাপ কাজ করলে নিন্দার ভয়। আবার-
অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ হলো- মিলের মতে বিবেকের তাড়না বা মানুষের সহানুভূতি ও নৈতিক অনুভূতি। যখন মানুষ অন্যের সুখের জন্য কাজ করে না, তখন তার বিবেক তাকে দংশন করে। এই অভ্যন্তরীণ অনুভূতিই মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরোপকারী হতে চালিত করে।
ন্যায় ও উপযোগবাদঃ মিল ন্যায় বিচারকে উপযোগবাদেরই একটি অংশ হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, ন্যায় মানুষের সামাজিক উপযোগিতা বাড়ায় এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে। ন্যায্য আচরণ সামগ্রিকভাবে সমাজের বৃহত্তর সুখের জন্য অপরিহার্য।
•উপযোগবাদের বিচার-
মিলের উপযোগবাদ বেন্থামের তত্ত্বকে আরও সূক্ষ্ম ও সমৃদ্ধ করেছে।তবুও এই তত্ত্বটি কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।আর সেখানে-
১) মিল সুখের গুণগত পার্থক্যের কথা বললেও, "উচ্চতর" সুখ এবং "নিম্নতর" সুখের মধ্যে কীভাবে বস্তুনিষ্ঠভাবে পার্থক্য করা যাবে তা স্পষ্ট নয়। কে নির্ধারণ করবে কোনটি উচ্চতর সুখ? মিল বলেছেন, যারা উভয় ধরনের সুখের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, তারাই উচ্চতর সুখকে বেছে নেবেন। কিন্তু এটি একটি বৃত্তাকার যুক্তি হতে পারে এবং এটি সার্বজনীনভাবে মেনে নেওয়া কঠিন।
বিচারের সীমাবদ্ধতাঃ সমালোচকরা বলেন, যদি সুখের গুণগত পার্থক্য থাকে, তবে তা সুখবাদের মূল ধারণার সঙ্গেই অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে। সুখবাদ সাধারণত সুখের পরিমাণকে গুরুত্ব দেয়, গুণকে নয়।
২) মিল দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ব্যক্তি তার নিজের সুখের পাশাপাশি অন্যদের সুখও কামনা করে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, প্রত্যেকে নিজের সুখ চায়, তাই সকলের সুখ সমষ্টিগতভাবে কাম্য। কিন্তু এই যুক্তিটি একটি যৌক্তিক ভ্রান্তির শিকার বলে অনেকে মনে করেন। কারণ, প্রতিটি ব্যক্তির নিজের সুখ চাওয়া মানে এই নয় যে, ব্যক্তি অপরের সুখকেও নিজের সুখের মতো একইভাবে চাইবে।
পরোপকারের প্রেরণঃ বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের (বিবেক) কথা বললেও, মানুষ কেন সব সময় নিজের সুখ উপেক্ষা করে অন্যের সুখকে প্রাধান্য দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
৩) উপযোগবাদ কখনো কখনো ন্যায্যতার ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। "সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ" নিশ্চিত করতে গিয়ে, কখনো কখনো সংখ্যালঘু বা দুর্বল অংশের অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি অধিকাংশের সুখের জন্য কিছু মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তবে তা উপযোগবাদ অনুযায়ী সঠিক হলেও ন্যায়সম্মত নাও হতে পারে
৪) উপযোগবাদ সম্পূর্ণরূপে কাজের ফলাফলের উপর নির্ভর করে নৈতিকতাকে বিচার করে। এর ফলে, কোনো কাজের উদ্দেশ্য বা প্রেরণার নৈতিক গুরুত্ব উপেক্ষিত হতে পারে। অনেক সময় একটি কাজের ফলাফল অনিশ্চিত বা অপ্রত্যাশিত হতে পারে, সেক্ষেত্রে সেই কাজের নৈতিকতা বিচার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৫) উপযোগবাদ কঠোর নীতিমালা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। এটি প্রায়শই প্রতিটি পরিস্থিতিতে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে, যা বাস্তব জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
৬)'সুখ'একটি বিষয়ভিত্তিক ধারণা। এক ব্যক্তির কাছে যা সুখ, অন্যের কাছে তা নাও হতে পারে। সুখ পরিমাপ করা কঠিন এবং বিভিন্ন ব্যক্তির সুখকে কীভাবে একত্রিত করে "সর্বাধিক সুখ" গণনা করা হবে, তা স্পষ্ট নয়
পরিশেষে বলা যায় যে, জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদ নৈতিক চিন্তাধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বেন্থামের স্থূল সুখবাদকে তিনি গুণগত দিক থেকে পরিমার্জন করে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক ক্ষমতার উপর জোর দিয়েছেন। তবে, সুখের গুণগত পার্থক্যের পরিমাপ, আত্মসুখ থেকে পরসুখে উত্তরণের যৌক্তিক ভিত্তি এবং ন্যায়ের সাথে সম্ভাব্য সংঘাতের মতো বিষয়গুলো নিয়ে তার উপযোগবাদ সমালোচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করার নীতিটি আজও নীতিশাস্ত্রের একটি প্রভাবশালী ধারা হিসেবে বিবেচিত হয়।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সাজেশন এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ও আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL 🙏
Comments
Post a Comment