ভারত তীর্থ কবিতার (4th.Sem.) মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশভক্তির অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে -আলোচনা করো।
'ভারত তীর্থ' কবিতার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশভক্তি বা দেশপ্রেম ও মানবতাবাদীর অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে- আলোচনা করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা মেজর)।
•আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ভারত তীর্থ' কবিতাটি তাঁর দেশপ্রেম ও মানবতাবাদী চিন্তার এক অসাধারণ অভিব্যক্তি। তবে এই কবিতায় তাঁর দেশভাবনা কোনো সংকীর্ণ ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ থাকেনি।বরং বলা যেতে পারে যে,তা এক উদার, সমন্বিত ও বিশ্বজনীন রূপ ধারণ করেছে।আর সেই ভারত তীর্থ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের দেশ ভাবনার যে বিভিন্ন দিকগুলি আমরা পাই, তাহলো-
•মহামানবের সাগরতীরে ভারতঃ আমরা জানি যে,রবীন্দ্রনাথের দেশ ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে ভারতকে 'মহামানবের সাগরতীর' হিসেবে কল্পনা করা। তাঁর কাছে ভারত কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, বরং ইতিহাসের আদিকাল থেকে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ও সংস্কৃতির মানুষের মিলনক্ষেত্র। আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, শক, হুন, পাঠান, মোগল, ইংরাজ, খ্রিস্টান – সকলেই এই ভারতে এসে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় মিলনই ভারতের প্রকৃত শক্তি ও মূল সৌন্দর্য।আর সেখানে -
•সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ হীনতাদেশ প্রেমঃকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা সম্প্রদায়গত ভেদাভেদকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি দেখেছেন যে, এই ভেদাভেদই দেশের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা। তাই তিনি হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্মণ, পতিত - সকলকে আহ্বান করেছেন একসঙ্গে হাত ধরে দেশমাতৃকার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য। তাঁর কাছে "ধর্ম হল মিলনের সেতু আর অধর্ম বিরোধের"। তিনি চান, "সকলের পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীড়ে" ভারত এক নতুন সমন্বয়ের প্রতীক হয়ে উঠুক।
•মানবচরিত্রের দেশঃরবীন্দ্রনাথ দেশ বলতে শুধু মাটির দেশকে বোঝেননি। তিনি বলেছেন- "দেশ বলতে কেবল তো মাটির দেশ নয়। সে যে মানবচরিত্রের দেশ।" •আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, দেশের বাহ্যিক প্রকৃতি যেমন আমাদের দেহ গড়ে তোলে, তেমনি মানব চরিত্রের দেশ থেকেই প্রেরণা পেয়ে আমাদের চরিত্র গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, দেশের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধই তাঁর কাছে মুখ্য।
•অতীত ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃকবি ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাসকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। আর সেই উপলব্ধি থেকে তিনি দেখেছেন, কীভাবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও ভারত তার নিজস্ব সত্তাকে টিকিয়ে রেখেছে এবং বহুত্ববাদের আদর্শকে লালন করেছে। একইসাথে তিনি ভবিষ্যৎ ভারতের এক উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে সকল ভেদাভেদ ঘুচিয়ে সকলে মিলেমিশে এক নতুন ভারতবর্ষ নির্মাণ করবে। আর সেখানে করি বার্তা দেন- "মঙ্গল ঘট হয়নি যে ভরা।" •আসলে এই পংক্তি দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের সেই শুভক্ষণের আগমনী বার্তা দিয়েছেন।
•বিশ্বচেতনা ও মানবতাবাদঃআমরা বলতে পারি যে,রবীন্দ্রনাথের দেশভাবনা শুধু ভারতের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি,বিশ্বমৈত্রীর এক উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের এই মিলন ও সমন্বয়ের আদর্শ সমগ্র বিশ্বের কাছে এক বার্তা পৌঁছে দেবে। তাঁর কাছে, ভারতবর্ষের সাধনা হল পৃথিবীর সকল দেশের সঙ্গে যাওয়া-আসার, নেওয়া-দেওয়ার সম্বন্ধ স্থাপন করা। এই মিলনের সত্যই সমস্ত মানুষের চরম সত্য।
•শাশ্বত সত্যের ঐক্যঃ কবি ভারতের উপর নেমে আসা অপমান, বিভেদ ও দুঃখকে মেনে নেননি। তিনি এই বেদনাকে অতিক্রম করে ঐক্য ও সংহতির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন- "এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অবমানভার" আসলে এই পংক্তিতে তাঁর সুদৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হয়েছে।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,'ভারত তীর্থ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথের দেশভাবনা এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে উদার মানবতাবাদ, সমন্বয়ের আদর্শ এবং বিশ্বমৈত্রীর বার্তাকেই তুলে ধরে। তিনি এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে সকল মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্ম দেবে।
Comments
Post a Comment