Skip to main content

ভারতীয় নীতিশাস্ত্র ও পাশ্চাত্য(4th.Sem) নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নিরুপন করো।

ভারতীয় নীতিশাস্ত্র ও পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নিরুপন করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন মাইনর)।

                আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,ভারতীয় নীতিশাস্ত্র এবং পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।আর এই পার্থক্যগুলো মূলত তাদের উদ্ভব,লক্ষ্য,পদ্ধতি  এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিহিত। নিহিত সেই পার্থক্যগুলি আমরা নিম্নে আলোচনা করলাম-

১) উদ্ভব ও উদ্দেশ্যগত পার্থক্য-

 ভারতীয় নীতিশাস্ত্রঃ ভারতীয় দর্শনের উদ্ভব হয়েছে মূলত জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তি এবং মোক্ষ লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে।যার প্রধান লক্ষ্য হলো, আত্ম-উপলব্ধি এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি অর্জন করা। তাই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি ব্যবহারিক দিকেরও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেকারণে এটি কেবল জ্ঞানের অন্বেষণ নয়, বরং সত্যের উপলব্ধির মাধ্যমে জীবনে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু-

     •পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রঃ পাশ্চাত্য দর্শনের উদ্ভব মূলত জ্ঞান লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে।যেটি জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করার ওপর গুরুত্ব দেয় এবং প্রায়শই তত্ত্বগত আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রের লক্ষ্য হলো যুক্তি ও বুদ্ধির  সাহায্যে নৈতিকতার সার্বজনীন নীতি ও সূত্র আবিষ্কার করা। এটি সাধারণত ইহলৌকিক জীবন এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই নৈতিকতার আদর্শকে সীমাবদ্ধ রাখে।

২) আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয়গত সংযোগ-

 •ভারতীয় নীতিশাস্ত্রঃ ভারতীয় নীতিশাস্ত্র মূলত আধ্যাত্মিক এবং ধর্মভিত্তিক (চার্বাক দর্শন ব্যতীত)। তবে এখানে দর্শন ও ধর্মকে অভিন্ন গণ্য করা হয়। যেমন, বৌদ্ধদর্শন ও বৌদ্ধধর্ম, জৈনদর্শন ও জৈনধর্ম, বেদান্ত দর্শন ও হিন্দুধর্ম – এ সবই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আত্মা, কর্মবাদ, পুনর্জন্মবাদ এবং মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের ধারণা ভারতীয় নীতিশাস্ত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু-

         •পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রঃ পাশ্চাত্য দর্শনের ক্ষেত্রে ধর্ম ও দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধর্মের উৎস মানুষের বিশ্বাস, যেখানে যুক্তিতর্কের কোনো স্থান নেই। অন্যদিকে, দর্শনের ভিত্তি হলো যুক্তি ও বুদ্ধি। তাই পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রে নৈতিক সিদ্ধান্তগুলো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল না হয়ে যুক্তি ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

৩) মনোযোগগত পার্থক্য-

ভারতীয় নীতিশাস্ত্রঃ ভারতীয় নীতিশাস্ত্র ব্যক্তি ও সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ এবং কর্মফলের (কর্ম) ওপর বিশেষ জোর দেয়। এখানে অহিংসা (অহিংসা), সত্য (সত্যতা), অস্তেয় (অচৌর্য) ইত্যাদির মতো নীতিগুলি ব্যক্তির চরিত্রের সহজাত গুণাবলী হিসাবে বিবেচিত হয় এবং এগুলি একটি জীবনযাপন পদ্ধতি হিসাবে দেখা হয়। আত্ম-উপলব্ধি এবং নির্বাণ বা মোক্ষ অর্জনের দিকে এর লক্ষ্য নিবদ্ধ। কিন্তু-

          •পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রঃ পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্র ব্যক্তিগত অধিকার, স্বায়ত্তশাসন এবং সামাজিক চুক্তির ধারণার ওপর জোর দেয়। এখানে ন্যায়বিচার, কর্তব্য এবং ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দার্শনিক যেমন কান্ট (কর্তব্যমূলক নীতি), মিল (উপযোগবাদ) এবং রলসের (ন্যায্যতা) কাজগুলিতে এই ধরনের চিন্তাভাবনা দেখা যায়।

৪) জ্ঞান ও পদ্ধতিগত পার্থক্যঃ 

ভারতীয় নীতিশাস্ত্রঃ ভারতীয় নীতিশাস্ত্র: ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে জ্ঞান অর্জনের জন্য যুক্তি ও ধ্যানের উপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। আধ্যাত্মিক অনুশীলন যেমন ধ্যান ও যোগের মাধ্যমে নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা সম্ভব বলে মনে করা হয়। এখানে 'দৃশ্য' ধাতুর অর্থ 'দেখা' বা 'জানা' হলেও ভারতীয় দর্শনে সত্য দর্শন, তত্ত্ব উপলব্ধি এবং জীবনের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করাকেও বোঝানো হয়। কিন্তু-

         •পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রঃ পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ এবং যৌক্তিক প্রমাণের উপর অধিক জোর দেওয়া হয়। এখানে সুসংবদ্ধ যুক্তি, চিন্তাভাবনার পরীক্ষা (যেমন ট্রলি সমস্যা) ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য।

৫) দুঃখবোধ ও আশাবাদগত পার্থক্য-

ভারতীয় নীতিশাস্ত্রঃ ভারতীয় দর্শন-জিজ্ঞাসার মূল উৎস হলো জীবন সম্বন্ধে এক গভীর অতৃপ্তিবোধ বা দুঃখবোধ। জীব-জগৎকে দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু জর্জরিত দেখে ভারতীয় দার্শনিকরা দুঃখের আত্যন্তিক মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেছেন। কিন্তু-

          •পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রঃ পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্র: পাশ্চাত্য দর্শন সাধারণত জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করাই এর লক্ষ্য। দুঃখবোধ পাশ্চাত্য দর্শনের মূল চালিকাশক্তি নয়, বরং সত্যের অন্বেষণই প্রধান।

              •পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ভারতীয় নীতিশাস্ত্র জীবন কেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে মোক্ষ বা আত্ম-উপলব্ধির  দিকে পরিচালিত করে।আর অপরদিকে  পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্র যুক্তি-কেন্দ্রিক, ইহলৌকিক এবং জ্ঞানলাভের মাধ্যমে নৈতিকতার সার্বজনীন নীতি অনুসন্ধানে নিয়োজিত।

ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏 ।

Comments

Popular posts from this blog

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...