Skip to main content

বেন্থামের উপযোগবাদ(4th.Sem,Philosophy) ব্যাখ্যা ও বিচার করো।

উপযোগবাদ কাকে বলে? বেন্থামের উপযোগবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন মাইনর)।

উপযোগবাদঃউপযোগবাদ হলো নীতিশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যে তত্ত্ব কোনো কাজের নৈতিকতা বিচার করে তার ফলাফল বা উপযোগিতার ভিত্তিতে। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, যে কাজটি সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ বা কল্যাণ বয়ে আনে, সেটিই নৈতিকভাবে সঠিক এবং ভালো কাজ।তবে-

            উপযোগবাদ অনুসারে, কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজের ভালো-মন্দ বিচার করতে হলে দেখতে হবে তার চূড়ান্ত ফলাফল কী। যদি কোনো কাজের ফলে সমাজের মোট সুখ বা আনন্দ বৃদ্ধি পায় এবং দুঃখ বা কষ্ট কমে, তবে সেই কাজটিই কাঙ্ক্ষিত। উপযোগবাদ ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে সামগ্রিক সুখ ও কল্যাণের ওপর বেশি জোর দেয়।তবে এই উপযোগবাদের প্রধান প্রবক্তা ও জনক হলেন জেরেমি বেন্থাম।

          জেরেমি বেন্থাম ছিলেন একজন ইংরেজ দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক এবং আধুনিক উপযোগবাদের (Utilitarianism) জনক। তাঁর উপযোগবাদ ছিল একটি নৈতিক দর্শন, যা কোনো কাজের ভালো-মন্দ বা উচিত-অনুচিত বিচার করে তার ফলাফলের ভিত্তিতে, বিশেষ করে সেই কাজের দ্বারা উৎপাদিত সুখ বা আনন্দের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে।

•বেথামের উপযোগবাদের ব্যাখ্যা•

              বেন্থামের মতে, প্রকৃতি মানুষকে দুটি সার্বভৌম নিয়ন্তার অধীনে রেখেছে। যেখানে সুখ (Pleasure) এবং দুঃখ (Pain) আমাদের সমস্ত কাজ, চিন্তা ও অনুভূতি এই দুইয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আসলে বেন্থাম বিশ্বাস করতেন যে, একটি কাজ তখনই নৈতিকভাবে সঠিক যখন সেটি সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ উৎপাদন করে। এই নীতিটি 'সর্বোচ্চ সুখ নীতি' নামে পরিচিত। আর সেখানে বেন্থামের উপযোগবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-

 ভোগসুখবাদীঃ বেন্থামের মতে, সুখ বলতে তিনি জাগতিক ও পার্থিব সুখকে বুঝিয়েছেন। এটি কোনো উচ্চ আধ্যাত্মিক সুখ নয়, বরং মানুষের বস্তুমুখী স্বার্থ ও সুবিধার সঙ্গে এর সম্পর্ক। তিনি প্লেটোর মতো ত্যাগবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।

পরিমাণগত দিকঃ বেন্থাম সুখের গুণগত পার্থক্যের পরিবর্তে পরিমাণগত পার্থক্যের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, সব সুখই সমান গুণসম্পন্ন; পার্থক্য কেবল তাদের পরিমাণে। তিনি বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন: "পরিমাণের তারতম্য না ঘটলে, খেলার সুখ (দৈহিক সুখ) ও কবিতা পাঠের সুখ (মানসিক সুখ) তুল্যমূল্য" (Quantity of pleasures being equal, pushpin is as good as poetry)। অর্থাৎ, যদি দুটি কাজের মাধ্যমে উৎপাদিত সুখের পরিমাণ সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই।

সুখকলনঃ বেন্থাম সুখ ও দুঃখ পরিমাপের জন্য একটি গাণিতিক পদ্ধতি প্রস্তাব করেছিলেন, যা "সুখকলন" নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে তিনি সুখকে কিছু মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিমাপ করার চেষ্টা করেন। আর সেই মাপকাঠি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন-তীব্রতা, স্থায়ীত্ব,নিয়শ্চয়তা বা অনিয়শ্চয়তা, নিকটবর্তিতা বা দূরবর্তিতা, বিশুদ্ধতা,উৎপাদনশীলতা,ব্যাপ্তি।

        এই মাপকাঠিগুলোর ভিত্তিতে যেকোনো কাজের মোট সুখ ও দুঃখের পরিমাণ গণনা করে দেখা হয় যে কাজটি সর্বাধিক সুখ উৎপাদন করছে কিনা।আর সেখানে-

ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়ঃবেন্থাম মনে করতেন, ব্যক্তি তার নিজের সুখ চায় এবং সমাজ সামগ্রিকভাবে সর্বাধিক সুখ চায়। তাঁর মতে, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চাপ এবং বিবেকবোধের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো সম্ভব।

•বেন্থামের উপযোগবাদের বিচার বা সমালোচনা•

স্থূল ভোগসুখবাদঃ সমালোচকরা বেন্থামের উপযোগবাদকে একটি স্থূল ও বৈষয়িক জীবনদর্শন বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, সুখ কেবল একটি মানসিক অবস্থা নয়, এর গুণগত দিকও গুরুত্বপূর্ণ। সব সুখকে কেবল পরিমাণ দিয়ে বিচার করা যায় না। কবিতা পাঠের আনন্দ এবং পশু-পিন খেলার আনন্দকে এক পাল্লায় মাপা সম্ভব নয়, কারণ এদের গুণগত পার্থক্য রয়েছে।

নৈতিক গুণগত দিকের অভাবঃবেন্থামের তত্ত্ব নৈতিক কাজের উৎস বা অভিপ্রায়ের পরিবর্তে কেবল ফলাফলের উপর জোর দেয়। অর্থাৎ, একটি কাজ সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে কিনা, তা এখানে বিচার করা হয় না, কেবল ফলাফলের উপর ভিত্তি করে এর নৈতিকতা নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে নৈতিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উপেক্ষিত হয়।

ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়ে ব্যর্থতা: বেন্থাম ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধনের কথা বললেও বাস্তবে এটি কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অনেক সময় ব্যক্তিস্বার্থ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে এবং বেন্থাম এই বিরোধ সমাধানের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী যুক্তি দিতে পারেননি। সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর এই সমন্বয় প্রচেষ্টা এক ধরনের স্থূল সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

সুখ পরিমাপের অবাস্তবতা বা সুখকলনঃসুখকলন পদ্ধতিকে অবাস্তব বলে মনে করা হয়। সুখ-দুঃখের মতো অনুভূতিকে গাণিতিক নিয়মে পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। প্রতিটি কাজের সম্ভাব্য সমস্ত সুখ-দুঃখের হিসাব করা এবং তাদের ফলাফল পূর্বানুমান করা কঠিন।

 

সংখ্যালঘুদের স্বার্থ উপেক্ষা: 'সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ' নীতি অনেক সময় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের সুখের জন্য সংখ্যালঘুদের উপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,উপরোক্ত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বেন্থামের উপযোগবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি এমন একটি নীতিশাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন যা সমাজে বাস্তবিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিল। তাঁর উপযোগবাদ আইনি সংস্কার, সামাজিক নীতি নির্ধারণ এবং সরকারের কার্যকারিতা মূল্যায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে। যদিও তাঁর ধারণাগুলো পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো দার্শনিকরা আরও পরিমার্জন করেন, তবু বেন্থামই প্রথম এই ধারণাকে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দেন এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগের উপর জোর দেন।আসলে,বেন্থামের উপযোগবাদ তার ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও নীতিশাস্ত্র এবং রাজনৈতিক দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, যা পরবর্তীতে আরও উন্নত আলোচনার পথ খুলে দিয়েছে।

ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সাজেশন, ব্যাখ্যা এবং ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDORBON YOUTUBE CHANNEL 🙏 

Comments

Popular posts from this blog

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...