Skip to main content

ভারতীয় দর্শনে চার্বাক(4th.Sem) নীতিতত্ত্ব সবিচার আলোচনা করো।

ভারতীয় দর্শনে চার্বাক নীতিতত্ত্ব সবিচার আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সেমিস্টার, দর্শন মাইনর)।

          আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,চার্বাক নীতিতত্ত্ব ভারতীয় দর্শনের এক বিশেষ ধারা, যে ধারা প্রচলিত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ধারণার বিপরীতে গিয়ে বস্তুবাদ এবং সুখবাদকে (Hedonism) কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। আর তার  মূল ভিত্তি হলো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং ইহলৌকিক সুখের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া।আর সেখানে -

•চার্বাক নীতি তত্ত্বের মূল নীতিঃ চার্বাকরা কোনো অলৌকিক সত্তা, পরকাল, আত্মা, ঈশ্বর বা কর্মফলে বিশ্বাসী নন। তাদের মতে, জীবন শুধু এই ইহলোকেই সীমাবদ্ধ এবং দেহাবসানের সাথে সাথেই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে তাদের নীতিতত্ত্ব গড়ে ওঠে।আর সেক্ষেত্রে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে বলেন- 

১) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণঃচার্বাকদের মতে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই (sensory perception) জ্ঞানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস। যা কিছু আমরা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা সরাসরি অনুভব করি, সেটাই সত্য। অনুমান (inference) এবং শাস্ত্রবাক্য (testimony) বা শব্দ প্রমাণকে তারা অস্বীকার করতেন। যেখানে আছে-

      •নৈতিক প্রভাবঃ  যেহেতু কেবলমাত্র প্রত্যক্ষই সত্য, তাই পরকাল, স্বর্গ-নরক, পুণ্য-পাপের ধারণাকে তারা অস্বীকার করতেন। এগুলি যেহেতু সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় না, তাই তাদের কাছে এগুলো অর্থহীন ছিল। এর ফলস্বরূপ, প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কোনো নৈতিক বাধ্যবাধকতা তারা দেখতেন না।

২)বস্তুবাদঃচার্বাকরা বিশ্বাস করতেন যে এই জগৎ কেবল চারটি ভূত অর্থাৎ ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন) এবং মরুৎ (বায়ু) দ্বারা গঠিত। চেতনা বা আত্মা এই চারটি উপাদানের বিশেষ সংমিশ্রণেই তৈরি হয়, ঠিক যেমন বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে মদ তৈরি হলে তাতে নেশার সৃষ্টি হয়। যখন দেহ বিনষ্ট হয়, তখন এই উপাদানগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং চেতনারও অবসান ঘটে। যেখানে আছে-

      •নৈতিক প্রভাবঃ আত্মার অমরত্ব বা পুনর্জন্মের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে, চার্বাকদের কাছে মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের কোনো গুরুত্ব ছিল না। তাদের মতে, যখন জীবনই ক্ষণস্থায়ী, তখন তার সদ্ব্যবহার করা উচিত বর্তমানের সুখ উপভোগ করে।

৩) সুখবাদ বা ভোগবাদঃচার্বাক নীতিতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সুখবাদ। তাদের মতে, জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সর্বাধিক ইন্দ্রিয়গত সুখ (sensory pleasure) অর্জন করা এবং দুঃখকে এড়িয়ে চলা। তাদের বিখ্যাত উক্তিটি হলো-          ‌।                                        "যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ,ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।" "        "ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।"অর্থাৎ -(যতদিন বাঁচবে, সুখে বাঁচো; ঋণ করে হলেও ঘি খাও। দেহ ভস্মীভূত হলে তার আর ফিরে আসে কোথা থেকে?)

       •নৈতিক প্রভাবঃ এই মতবাদ মানুষকে বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হতে এবং জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে উৎসাহিত করে। তারা মনে করতেন, পরকালের কল্পিত সুখের জন্য ইহকালের দুঃখ বরণ করা বোকামি। তাদের কাছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দময় করে তোলাই ছিল আসল ধর্ম। তারা পুণ্য অর্জনের জন্য কষ্ট সহ্য করা বা তপস্যা করার বিরোধী ছিলেন।

৪) ধর্মীয় আচার ও সামাজিক প্রথা প্রত্যাখ্যানঃ চার্বাকরা প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, যজ্ঞ, দান, তীর্থযাত্রা, তপস্যা এবং বর্ণপ্রথাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতেন। তাদের মতে, এগুলি সব পুরোহিতদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৈরি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষকে শোষণ করার একটি উপায়।আর সেখানে আমরা দেখি- 

       •নৈতিক প্রভাবঃ চার্বাকরা কোনো নৈতিক বিধিনিষেধকে ঐশ্বরিক বা শাস্ত্রীয় আজ্ঞা হিসেবে মানতেন না। তাদের কাছে প্রচলিত নৈতিকতার ভিত্তি ছিল মানবসৃষ্ট এবং মানুষের সুখের পরিপন্থী। তাই তারা প্রচলিত নৈতিকতার বদলে আত্মসুখকেই প্রধান মূল্য হিসেবে দেখতেন।

                 •সমালোচনার দৃষ্টিতে চার্বাকবাদ•

•জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতাঃচার্বাকরা প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস মনে করলে মানব জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে যায়। বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং দৈনন্দিন জীবনের বহু তথ্যই অনুমানের উপর নির্ভরশীল।

•সামাজিক বিশৃঙ্খলাঃ যদি প্রত্যেকেই শুধু নিজের ব্যক্তিগত সুখের পিছনে ছোটে, তাহলে সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে। স্বার্থপরতা বাড়তে পারে এবং অন্যের অধিকার ও কল্যাণের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হতে পারে।

•নৈতিক শূন্যতাঃ চরম সুখবাদ মানুষকে অশুভ কর্মে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করতে পারে, যদি তাতে তাদের তাৎক্ষণিক সুখ লাভ হয়। এর ফলে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটতে পারে।

 •দুঃখকে অস্বীকারঃ চার্বাকরা দুঃখকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যেতে বললেও, দুঃখ মানব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুঃখের অভিজ্ঞতা ছাড়া সুখের প্রকৃত মূল্য বোঝা কঠিন।

•ইন্দ্রিয়সুখ প্রাধান্যঃ চার্বাক নীতিতত্ত্বে মূলত ইন্দ্রিয়গত সুখের উপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু মানব জীবনে মানসিক শান্তি, জ্ঞানার্জন, শিল্প, সাহিত্য বা পরোপকারের মতো উচ্চতর ও সূক্ষ্ম আনন্দও গুরুত্বপূর্ণ।

             •পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,চার্বাক নীতিতত্ত্ব ভারতীয় দর্শনে একটি ব্যতিক্রমী এবং সাহসী ধারা। আসলে এটি মানুষকে প্রচলিত চিন্তাধারাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল এবং জীবনের প্রতি এক ধরনের আশাবাদ ও বর্তমানের প্রতি মনোযোগের বার্তা দিয়েছিল। তবে, এর চরম বস্তুবাদী ও ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে এটি ভারতীয় দর্শনের মূল স্রোতে স্থান পায়নি।তবে-

          চার্বাক নীতিতত্ত্ব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং এর আনন্দ প্রত্যেককে উপভোগ করা উচিত, কিন্তু একই সাথে এটি আমাদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব এবং বৃহত্তর নৈতিকতার গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসে।

ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDARBAN" Youtube channel 🙏 

Comments

Popular posts from this blog

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...