Skip to main content

বেন্থামের উপযোগবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো।

বেন্থামের উপযোগবাদ ব্যাখ্যা ও বিচার করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ সেমিস্টার দর্শন মাইনর)।

        •আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,  বেন্থাম একজন প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক, আইনতত্ত্ববিদ এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে আধুনিক উপযোগবাদের জনক হিসেবে গণ্য করা  হয়।তাই তাঁর এই তত্ত্বটি মূলত উপযোগ বা লাভের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আর সেখানে-                                                                                   •বেন্থামের উপযোগবাদের মূল বক্তব্যঃবেন্থামের উপযোগবাদের মূল ভিত্তি হলো সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ। তার মতে, কোনো কাজ নৈতিকভাবে তখনই সঠিক বা ভালো, যখন তা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ বা আনন্দ উৎপাদন করে। এর বিপরীতে, যে কাজ দুঃখ বা কষ্ট নিয়ে আসে, তা অনৈতিক।আর সেখানে-

          •ভোগসুখবাদের দিকঃ বেন্থামের মতে, মানুষের সকল কাজের মূলে রয়েছে সুখের অন্বেষণ এবং দুঃখ পরিহারের প্রবণতা।আসলে তাঁর কাছে সুখ বলতে উচ্চমার্গের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক সুখ নয়, বরং ব্যবহারিক জীবনের পার্থিব সুখকে বোঝায়। যা মানুষ নিজের সুখের সন্ধানেই ছোটে এবং নিজের সুখেই তৃপ্ত হয়।তাই তিনি প্লেটোর ত্যাগবাদ নীতিকে অসাড় বলে সমালোচনা করেছেন। কারণ আত্মসুখ বর্জনের নীতি সর্বদা অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

           •পরিমাণগত দিকঃ বেন্থাম সুখের গুণগত দিকের চেয়ে পরিমাণগত দিকের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, সব সুখই গুণগতভাবে সমান এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য কেবল পরিমাণগত। তাই তিনি famously বলেছেন, "Quantity of pleasures being equal, pushpin is as good as poetry" (সুখের পরিমাণ সমান হলে, পিন খেলার আনন্দ আর কবিতা পাঠের আনন্দের মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই)। অর্থাৎ, যে কাজ যত বেশি পরিমাণে সুখ উৎপন্ন করবে, সেটাই তত বেশি কাম্য।

             • সুখকলনঃ বেন্থাম বিশ্বাস করতেন যে, সুখ এবং দুঃখ পরিমাপ করা সম্ভব। আর এই পরিমাপের জন্য তিনি একটি গাণিতিক পদ্ধতিকে 'সুখকলন' বলে অবহিত করেন।তবে তিনি এই পদ্ধতিতে তিনি সুখের তীব্রতা, স্থায়িত্ব, নিশ্চয়তা, নৈকট্য, উৎপাদনশীলতা,এবং বিশুদ্ধতা এই ৭টি দিক বিবেচনা করতে বলেছেন। যে কাজের ফলস্বরূপ প্রাপ্ত সুখের পরিমাণ দুঃখের পরিমাণের চেয়ে বেশি হবে, সেটাই নৈতিকভাবে সঠিক।

              •ব্যক্তি ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়ঃ বেন্থাম মনে করতেন যে, ব্যক্তিস্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তার মতে, মানুষ আত্মসুখ অর্জনের পাশাপাশি পরার্থ-সুখ লাভের প্রবণতাও রাখে। তিনি যুক্তি দেন যে, যখন একজন ব্যক্তি নিজের সুখের জন্য কাজ করে, তখন সে সমাজের বৃহত্তর সুখের জন্যও পরোক্ষভাবে অবদান রাখতে পারে। সরকারের উচিত এমন আইন প্রণয়ন করা যা জনগণের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।

          •বেন্থামের উপযোগবাদের বিচার•

          • জীবন দর্শনঃ অনেক সমালোচক বেন্থামের উপযোগবাদকে একটি অতি স্থূল বৈষয়িক জীবনদর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন।আর তাদের মতে, এটি মানুষের নৈতিকতাকে কেবল ফলাফল বা সুখের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে বিচার করে, যা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এবং উদ্দেশ্যের গভীরতাকে উপেক্ষা করে।

          •নৈতিক ধারণা অস্বীকারঃ বেন্থাম নৈতিক মূল্যবোধ বা বিবেকের গুরুত্বকে খুব বেশি দেননি, বরং সুখের অন্বেষণকেই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা এবং কর্তব্য বলে চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে মানুষের সহজাত নৈতিকতা বা ভালো-মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা উপেক্ষিত হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।

            •ব্যক্তি ও সামাজিক স্বার্থের ব্যর্থতাঃ সমালোচকরা মনে করেন যে, বেন্থাম ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ বাস্তবে আত্মসুখ এবং পরসুখের মধ্যে সর্বদা একটি নিখুঁত সমন্বয় ঘটে না।

            •সুখের গুণগত পার্থক্য অস্বীকারঃ জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি বেন্থামেরই উত্তরসূরি, বেন্থামের এই পরিমাপগত দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করেন। মিলের মতে, সুখের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। কিছু সুখ (যেমন মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সুখ) দৈহিক সুখের চেয়ে উচ্চতর এবং অধিক মূল্যবান। "Socrates dissatisfied is better than a fool satisfied" - এই উক্তিটি দিয়ে মিল বোঝাতে চেয়েছেন যে, উন্নত মানের সুখের আকাঙ্ক্ষা একটি নৈতিক জীবনের জন্য অপরিহার্য, কেবল সুখের পরিমাণই যথেষ্ট নয়।

                •পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,বেন্থামের উপযোগবাদ নৈতিক এবং আইনী চিন্তাধারায় একটি বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছিল।তবে এটি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের উপর জোর দিয়েছিল।আর সেই কারণে পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো দার্শনিকদের দ্বারা আরও পরিমার্জিত হয়। তবে তাঁর তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, এটি আধুনিক নীতিশাস্ত্র এবং আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏 


Comments

Popular posts from this blog

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...