Skip to main content

বাঙালি ঘরের কথাই বড় হ'য়ে দেখা দিয়েছে শাক্ত পদাবলীতে-শাক্তপদ অবলম্বনে মন্তব্যটির সার্থকতা বিচার করো।

"বাঙালির ঘরের কথাই বড় হ'য়ে দেখা দিয়েছে শাক্ত পদাবলীতে"- শাক্তপদ অবলম্বনে মন্তব্যটির সার্থকতা বিচার করো(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার, বাংলা মেজর)

             আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,"বাঙালির ঘরের কথাই বড় হ'য়ে দেখা দিয়েছে শাক্ত পদাবলীতে" -এই মন্তব্যটি শাক্ত পদাবলীর আগমনী ও বিজয়া পর্যায়ের পদগুলির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সার্থক।আর সেখানে এই পদগুলিতে পৌরাণিক চরিত্রগুলি (যেমন উমা, মেনকা, শিব, হিমালয়) যেন বাংলার সাধারণ ঘরের মানুষ হয়ে ধরা দিয়েছে, আর তাদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, আকাঙ্ক্ষা-বিরহ বাঙালির চিরন্তন পারিবারিক জীবনেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। সেই প্রতিচ্ছবিতে আমরা দেখতে পাই-

         শাক্ত পদাবলীতে পারিবারিক জীবনের প্রতিফলন। তবে শাক্ত পদাবলীর মূল বিষয়বস্তু যদিও শক্তি আরাধনা, কিন্তু উমাসঙ্গীত বা আগমনী-বিজয়ার পদগুলি বাঙালির হৃদয়কে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে তার প্রধান কারণ হল এর বাৎসল্য রস এবং পারিবারিক আবেশ। সেখানে-

            •আদর্শ বাঙালি মা,মা মেনকাঃশাক্ত পদাবলীর অন্যতম প্রধান চরিত্র হলেন মা মেনকা। তিনি কোনো দেবী নন, বরং বলা যায়, তিনি এক আদর্শ বাঙালি মা। তাঁর কন্যার জন্য আকুলতা, উমাকে পিত্রালয়ে নিয়ে আসার জন্য হিমালয়কে পীড়াপীড়ি, উমার আগমনকে কেন্দ্র করে তাঁর আনন্দ, এবং বিজয়ার দিনে উমার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়ার বেদনায় তাঁর যে হাহাকার - এ সবই বাঙালির চিরন্তন মাতৃহৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তাই মেনকা কন্ঠে আমরা শুনতে পাই-            "তনয়া পরের ধন, বুঝিয়া না বুঝে মন।                                হায় হায় একি বিড়াম্বনা বিধাতার।।" ।                  রামপ্রসাদের এই পদটি বাঙালি মাতৃজীবনের এক চরম বাস্তব ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরে। আবার পরক্ষণেই মেনকার কন্ঠে শুনতে পাই-

 "গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না। বলে বলুক লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।।"

         •বাঙালির ঘরের মেয়ে, উমাঃ দেবীকন্যা উমাও এখানে নিছকই এক দেবী নন, তিনি যেন বাঙালির ঘরের বিবাহিতা মেয়ে।পিতৃগৃহে আসার জন্য তাঁর ব্যাকুলতা, মায়ের প্রতি তাঁর অভিমান, শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় তাঁর বেদনা - এ সবই বাঙালি কন্যাকুলের চিরন্তন অনুভূতি। তিনি স্বামীর সঙ্গে খুনসুটি করেন, মা মেনকার সঙ্গে আবদার করেন, যা যেকোনো বাঙালি মেয়ের জীবনেই স্বাভাবিক। শাক্ত কবিদের হাতে উমা যেন এক স্নেহময়ী কন্যা, স্বামীসোহাগিনী বধূ এবং সেবাপরায়ণা গৃহিণী রূপে প্রকাশিত হয়েছেন।

         •বাঙালি ঘরের জামাই, শিবঃ মহাদেব শিবও এখানে দেবত্ব ছেড়ে সাধারণ বাঙালি জামাইয়ের চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। তিনি দরিদ্র, ভবঘুরে, নেশাগ্রস্ত। এমন জামাইকে কন্যাদান করে মেনকার মনে যে উদ্বেগ, তা তৎকালীন বাঙালি সমাজের কুলীন ব্রাহ্মণ জামাইদের প্রতি মায়ের উদ্বেগেরই প্রতিরূপ। শিবের দারিদ্র্য, তাঁর দুটি বিবাহ - এ সবই বাঙালি পরিবারের বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরে।

        •বাঙালি ঘরের বাবা, হিমালয়ঃ গিরিরাজ হিমালয় এখানে এক প্রশান্ত, সৌম্য মধ্যবয়স্ক বাঙালি পিতার প্রতিরূপ। স্ত্রীর মতো অতটা আকুলতা বাইরে প্রকাশ না করলেও, তিনি মেনকার আর্তি বোঝেন এবং কন্যার প্রতি তাঁর গভীর স্নেহ লক্ষ্য করা যায়।

       •সমাজ ও সংস্কারে চিত্রঃ  শাক্ত পদাবলী কেবল দেব-দেবী বা ভক্তের আর্তিই প্রকাশ করেনি, বরং সেই সময়ের বাঙালি সমাজের পারিবারিক জীবন, আর্থিক অবস্থা, এবং নানা সামাজিক সমস্যাও এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। রথ দেখা ও কলা বেচার মতো এই পদগুলি একদিকে যেমন ধর্মীয় ভক্তিভাবকে জাগিয়ে তুলেছে, তেমনি অন্যদিকে বাঙালি গৃহস্থ জীবনের এক অকৃত্রিম ছবিও ফুটিয়ে তুলেছে।                                     পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শাক্ত পদাবলীতে বর্ণিত কৈলাস এবং মানস সরোবর যেন বাংলার আমবাগান, পানাপুকুরের কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেব-দেবী চরিত্রগুলি যেন বাঙালির আটপৌরে জীবনে মিশে গিয়ে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই ফুটিয়ে তুলেছে। আর এই কারণেই "বাঙালির ঘরের কথাই বড় হ'য়ে দেখা দিয়েছে শাক্ত পদাবলীতে" এই মন্তব্যটি সম্পূর্ণ রূপে সার্থক, প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ।আসলে শাক্ত পদাবলী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি, যা মানবিক আবেদন এবং জীবনরসে অভিষিক্ত হয়ে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে।

ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏 


Comments

Popular posts from this blog

ইতিহাস (3rd Semester) সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর।

 তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় সেমিস্টার ইতিহাস মাইনর)। ১)বন্দেগান-ই-চাহালগানি বলতে কী বোঝায়? •উত্তরঃবন্দেগান-ই-চাহালগান বলতে চল্লিশ জন তুর্কি ও অ-তুর্কি দাসদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনীকে বোঝায়। এই বাহিনীকে ডাল চালিশা বা তুরকান-ই- চাহালগানি নামে ডাকা হতো। ২)আমির খসরু কে ছিলেন? •উত্তরঃ আমির খসরু ছিলেন প্রখ্যাত সুফি সাধক বা আরেফ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছাত্র এবং অন্যতম প্রধান খলিফা। যাঁকে 'ভারতের তোতা' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ৩) মহরানা প্রতাপ কে ছিলেন?  •উত্তরঃ মেবারের শিশোদিয়া রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা ছিলেন মহারানা প্রতাপ সিং। যিনি রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ৪) জায়গীরদারী সংকট কী? •উত্তরঃ জায়গিরদারী সংকট ছিল মোগল সাম্রাজ্যের একটি অর্থনৈতিক সংকট। এই সংকটে জমি বা জায়গিরের অভাব দেখা দিয়েছিল। যার ফলে প্রশাসনিক খরচ মেটানো এবং যুদ্ধের খরচ বহন করা সম্ভব হতো না। ৫) দাক্ষিণাত্য ক্ষত কী? •উত্তরঃ দাক্ষিণাত্য ক্ষত বলতে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীত...

ব্রিটিশ(3rd.Sem) পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাইনর সিলেবাস)। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি, পার্লামেন্ট প্রণীত আইন প্রভৃতির মাধ্যমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট আইনানুগ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নয়। আর সেখানে আইনানুগ সার্বভৌমত্ব বলা হয়, কারণ-       যেকোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণনয়নের অধিকারী। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় পার্লামেন্টে কোন আইন প্রণয়নের সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। কমন্সসভা তথা নিম্নকক্ষের সার্বভৌমত্বকেই বলা হয় পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব।     ••ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সার্বভৌমত্ব বলার কারণ- ১) পার্লামেন্টের ওপর আইনগত কোনরূপ বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। ২) পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের বৈধতার ব্যাপারে আদালত কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা। ব্রিটেনের আদালত পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার দ্বারা সীমিত করতে পারে না। ৩) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার উপর শাসনবিভাগ অনুরূপ ন...

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

দর্শন প্রথম সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাইনর সিলেবাস)  ১)চার্বাক মতে ভূত কয়টি ও কি কি? উত্তরঃচার্বাক মতে ভূত চারটি- ক্ষিতি, অপ্ , তেজ ও মরুৎ ২) স্বভাববাদ কী? উত্তরঃ চার্বাক জড়বাদের ভিত্তি হল স্বভাববাদ। যে মতবাদ অনুসারে স্বভাব থেকেই ভূত সৃষ্টি, আবার স্বভাব থেকেই বিচ্ছেদ। যার জন্য ঈশ্বরকে স্বীকার করা প্রয়োজন নেই। ৩) অব্যাপ্যদেশ কথাটির অর্থ লেখো। উত্তরঃ অব্যাপ্যদেশ বলতে বোঝায়- অশাব্দ অর্থাৎ যাকে শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। ৫) জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ কাকে বলে?  কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার নিজের বিষয়ীভূত গুণ ছাড়াও যদি অপর একটি ইন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত গুণকে প্রত্যক্ষ করার হয়, তাহলে সেই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলা হয়। ৬) ন্যায় মতে প্রমাণের প্রকার  উত্তরঃ ন্যায় মতে প্রমাণ চার প্রকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শাব্দ। ৭) সন্নিকর্ষ কাকে বলে? উত্তরঃ ন্যায় মতে ইন্দ্রিয় ও কোন বাস্তব পদার্থের মধ্যে একপ্রকার বিশেষ সম্পর্ক ঘটলে তবেই আমাদের একটি বস্তুর প্রত্যক্ষজ্ঞান ।আর ঐ বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের পারিভাষিক নাম হলো সন...