বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় সেমিস্টার, বাংলা মেজর)
•আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস। তাঁরা দুজনেই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে তাঁদের কাব্যের মূল উপজীব্য করলেও তাঁদের প্রকাশভঙ্গি, ভাষা এবং কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাবে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নিচে তাঁদের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলোচনা করা হলো:
•ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিগত পার্থক্য•
বিদ্যাপতিঃআমরা জানি যে, বিদ্যাপতি মূলত মৈথিলী ভাষার কবি ছিলেন। তাঁর পদাবলীতে কোমলকান্ত পদাবলী এবং শব্দচাতুর্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি সংস্কৃত এবং মৈথিলী ভাষার সংমিশ্রণে এক নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন, যা ব্রজবুলি নামে পরিচিত। তাঁর পদে আলঙ্কারিক প্রয়োগ, উপমা ও উৎপ্রেক্ষার প্রাচুর্য দেখা যায়। তিনি প্রেমের বাহ্যিক রূপ, সৌন্দর্য এবং বিলাসের বর্ণনায় পারদর্শী ছিলেন। অপরপক্ষে -
চন্ডীদাসঃ চণ্ডীদাস ছিলেন বাংলা ভাষার কবি। তাঁর পদে ভাষার জটিলতা কম, তা সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত। চণ্ডীদাস হৃদয়াবেগ এবং প্রেমের গভীরতা প্রকাশে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর পদে লোকায়ত জীবনের প্রভাব এবং মানবিক অনুভূতির প্রকাশ বেশি। তাঁর পদাবলীতে নিবিড় আত্মসমর্পণ এবং রাধার বিরহ-বেদনার মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায়।
•রাধাকৃষ্ণের প্রেমচেতনা•
বিদ্যাপতিঃ বিদ্যাপতির পদে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মূলত সৌন্দর্য ও যৌবনের প্রেম। এটি পার্থিব সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ, মিলনাকাঙ্ক্ষা এবং বিলাসের ছোঁয়া দিয়ে সমৃদ্ধ। বিদ্যাপতি রাধার রূপ বর্ণনা, কৃষ্ণের প্রতি তাঁর আসক্তি এবং তাঁদের লীলাখেলাকে এক নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তাঁর রাধা একজন অভিজাত পরিবারের যুবতী, যিনি প্রেমের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ উপভোগ করেন।
চন্ডীদাসঃ চণ্ডীদাসের পদে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিবিড় আত্মনিবেদন এবং হৃদয়গত প্রেম। এই প্রেম শরীরী বন্ধনমুক্ত, যা কেবল আত্মার মিলনকে গুরুত্ব দেয়। চণ্ডীদাস রাধার বিরহ, আত্মত্যাগ এবং প্রেমের জন্য চরম দুঃখ বরণের চিত্র অঙ্কন করেছেন। তাঁর রাধা একজন সাধারণ নারী, যিনি প্রেমের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। তাঁর পদে প্রেমের 'সাঁচি পিরীতি' বা শাশ্বত প্রেমের ধারণা ফুটে উঠেছে।
•কাব্যরস ও ভাষা•
বিদ্যাপতিঃ বিদ্যাপতির পদে মধুর রস প্রধান। তাঁর কাব্যে শৃঙ্গার রসের বিভিন্ন দিক, যেমন - পূর্বরাগ, মিলন, সম্ভোগ, ইত্যাদি সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর পদাবলীতে এক ধরনের উজ্জ্বলতা এবং বর্ণময়তা রয়েছে। তিনি প্রেমের উচ্ছ্বাস এবং আনন্দের দিকটি তুলে ধরেছেন।
চন্ডীদাসঃচণ্ডীদাস: চণ্ডীদাসের পদে করুণ রস এবং বিরহ বেদনা প্রাধান্য লাভ করেছে। তাঁর পদাবলীতে রাধার আর্তনাদ, আক্ষেপ এবং গভীর প্রেমজনিত যন্ত্রণার প্রকাশ দেখা যায়। চণ্ডীদাস প্রেমের দুঃখ এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে গভীর আনন্দ লাভ করা যায়, সেই দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন।
•ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও প্রভাব•
বিদ্যাপতিঃ বিদ্যাপতি সম্ভবত ১৪শ শতকের কবি। তিনি মিথিলার রাজসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁর কাব্যে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রভাব দেখা যায়। যার ফলে বিদ্যাপতির পদগুলি গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং স্বয়ং চৈতন্যদেব তাঁর পদাবলীতে বিভোর থাকতেন।
চন্ডীদাসঃচণ্ডীদাস সম্ভবত ১৪শ-১৫শ শতকের কবি। বৈষ্ণব কাব্যে তাঁর জীবন নিয়ে অনেক বিতর্ক এবং "চণ্ডীদাস সমস্যা" রয়েছে। তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে তিনি সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে এসেছিলেন এবং তাঁর পদে সেই সাধারণ জীবনের প্রতিফলন দেখা যায়। চণ্ডীদাসের পদগুলি বাঙালি হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে এবং তাঁর মানবতাবাদী প্রেমচেতনা পরবর্তী অনেক কবিকে প্রভাবিত করেছে।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,বিদ্যাপতি তাঁর বর্ণিল ভাষা ও আলঙ্কারিক প্রয়োগে প্রেমের বাহ্যিক সৌন্দর্য ও আনন্দকে ফুটিয়ে তুলেছেন, অন্যদিকে চণ্ডীদাস তাঁর সরল অথচ গভীর প্রকাশভঙ্গিতে প্রেমের আত্মনিবেদন, বিরহ এবং আধ্যাত্মিক দিকটিকে উন্মোচন করেছেন। দুজনেই বাংলা বৈষ্ণব পদাবলীকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং তাঁদের অবদান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
Comments
Post a Comment