'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থ অবলম্বনে তৎকালীন নবদ্বীপের সমাজচিত্রের পরিচয় দাও(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা মেজর)।
আলোচনা শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থটি বৃন্দাবন দাস ঠাকুর কর্তৃক রচিত একটি অন্যতম জীবনীগ্রন্থ। শুধুমাত্র তাই নয় এই গ্রন্থটি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনীর উপর ভিত্তি করে লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। আর এই প্রেক্ষিতে গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র চৈতন্যদেবের অলৌকিক লীলা বর্ণনা করা হয়নি।বরং বলা যেতে পারে যে, গ্রন্থটিতে তৎকালীন নবদ্বীপের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনের এক সুস্পষ্ট চিত্রও ফুটে উঠেছে। আর সেই ক্ষেত্রে আমরা দেখি-
তৎকালীন নবদ্বীপের সামাজিক চিত্রঃ 'চৈতন্যভাগবত' থেকে নবদ্বীপের যে সামাজিক চিত্রটি আমরা পাই, তা প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত-প্রাক-চৈতন্য যুগ এবং চৈতন্য-পরবর্তী যুগ। সেখানে-
•প্রাক-চৈতন্য যুগের নবদ্বীপের সমাজ•
•শিক্ষার কেন্দ্রঃ নবদ্বীপ ছিল সেই সময়কার ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন শাস্ত্র, বিশেষত নব্য ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের গভীর চর্চা হতো। অসংখ্য পণ্ডিত ও ছাত্রের সমাগমে নবদ্বীপ মুখরিত থাকত। সেই কারণেই নবদ্বীপ হয়ে উঠেছিল ছাত্র সমাজের শিক্ষার অমূল্য শিক্ষার পীঠস্থান। সেখানে-
•আভিজাত্য ও পণ্ডিতদের দম্ভঃ সমাজে পণ্ডিতদের বিশেষ সম্মান ছিল, কিন্তু অনেক সময় তাঁদের মধ্যে পাণ্ডিত্যের অহংকার দেখা যেত। এই অহংকার থেকে একে অপরের সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিতর্কে লিপ্ত হতেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। চৈতন্যদেবের বাল্যকালের 'দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত' এর কাহিনী থেকে এই বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি -
•ধর্মীয় আচারণ ক্ষেত্রঃ হিন্দু সমাজে প্রধানত শাক্ত ও স্মার্ত মতের প্রাধান্য ছিল। যজ্ঞ, পূজা-পার্বণ এবং অন্যান্য বৈদিক ও তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান পালিত হতো। এই ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুন ও বাহ্যিক আড়ম্বর। তাই নয়, পাশাপাশি- •তৎকালীন সময়ে নবদ্বীপে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ছিল অতি সরল ও সাবলীল। কৃষি ও ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। সমাজের একটি বড় অংশই নিরক্ষর ছিল, এবং তারা পণ্ডিতদের ধর্মীয় বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদের মতো করে ধর্ম পালন করতে অভ্যস্ত ছিল।
•চৈতন্য-পরবর্তী যুগের সমাজ•
•ভক্তি আন্দোলনঃ চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পর নবদ্বীপের সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। নাম-সংকীর্তন এবং ভক্তি আন্দোলনের ফলে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ একত্রিত হয়।আর সেখানে - • চৈতন্যদেব জাতিভেদের উর্ধ্বে উঠে সকলকে কৃষ্ণনাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁর পার্ষদদের মধ্যে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে নিম্নবর্ণের মানুষও ছিলেন, যা তৎকালীন সমাজের কঠোর জাতিভেদ প্রথার উপর একটি বড় আঘাত ছিল। হরিদাস ঠাকুর ও নিত্যানন্দ প্রভু এর অন্যতম উদাহরণ।
•সামাজিক বন্ধনঃ নাম সংকীর্তন ও ভক্তিভাবের মাধ্যমে এক নতুন সামাজিক বন্ধন তৈরি হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ একসঙ্গে প্রেম ও ভক্তির ডোরে আবদ্ধ হয়। পূর্বে যেখানে পণ্ডিতদের অহংকার ছিল, সেখানে এখন বিনয় ও ভক্তিই প্রধান হয়ে ওঠে।
তৎকালীন সময়ে নারীর মর্যাদাঃ চৈতন্যভাগবতে শচীমাতা, বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী, মালিনী দেবী প্রমুখ নারীর চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় তৎকালীন সমাজে নারীর সম্মান ও মর্যাদা ছিল। বিশেষত শচীমাতা একজন আদর্শ জননী হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন।
•নবদ্বীপের ধর্মীয় চিত্রণ•
তৎকালীন সময়ে ধর্মীয় ক্ষেত্রেও চৈতন্যভাগবত নবদ্বীপের একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। বিচিত্রে আমরা দেখতে পাই যে-
•শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের দ্বন্দ্বঃ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে নবদ্বীপে শাক্ত ধর্মের প্রভাব ছিল প্রবল। বৈষ্ণব ধর্ম কিছুটা কোণঠাসা ছিল। চৈতন্যদেব যখন সংকীর্তন শুরু করেন, তখন স্থানীয় কাজীর নেতৃত্বে শাক্ত ও স্মার্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা এর বিরোধিতা করে।
•নাম সংকীর্তনের বিস্তারঃ চৈতন্যদেব সংকীর্তনকে ধর্মের একটি নতুন রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। বাহ্যিক আড়ম্বর ও জটিল শাস্ত্রীয় নিয়ম-কানুনকে দূরে সরিয়ে সহজ সরল কৃষ্ণনাম জপের মাধ্যমে ভক্তি অর্জনের পথ দেখান। এটি সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই- • চৈতন্যদেবের প্রভাবে নবদ্বীপের ধর্মীয় জীবনে এক নতুন সমন্বয় দেখা যায়। সংকীর্তনে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষ একত্রিত হতে শুরু করে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, 'চৈতন্যভাগবত' শুধুমাত্র একটি জীবনীগ্রন্থ নয়, এটি আসলে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের নবদ্বীপের সমাজ ও সংস্কৃতির একটি প্রামাণ্য দলিল। আর সেই দলিল থেকে আমরা জানতে পারি যে,নবদ্বীপ একসময় ছিল পাণ্ডিত্য ও অহংকারের কেন্দ্র। যা চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেম ও ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে রূপান্তরিত হয়ে প্রেম ও ভক্তির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে আমরা বলতে পারি যে, বৃন্দাবন দাস ঠাকুর তাঁর গ্রন্থে তৎকালীন নবদ্বীপের এক পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ও ধর্মীয় ছবি তুলে ধরেছেন একটি সামাজিক দলিল এবং গ্রন্থটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ।
•ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏
Comments
Post a Comment