নৌবিদ্রোহের কারণগুলি আলোচনা করো।
আমরা জানি যে,১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা 'নৌবিদ্রোহ'। আর এই বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের নৌসেনারা বিদ্রোহ করে, তা ব্রিটিশ শাসনের ভিত নড়িয়ে দেয়। আর এই বিদ্রোহের যে কারণগুলি ছিল,তাহলো-
১)বৈষম্যময় জীবনযাত্রাঃনৌবিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশ ও ভারতীয় নৌসেনাদের মধ্যে চরম বৈষম্য। যেখানে ব্রিটিশ নৌসেনাদের তুলনায় ভারতীয় নৌসেনাদের অনেক কম বেতন দেওয়া হতো। তাদের বাসস্থান, খাদ্য এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন। ভারতীয় নাবিকদের প্রায়শই বাসি ও পচা খাবার সরবরাহ করা হতো, যা তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জানা বাঁধে।
২) ব্রিটিশ অফিসারদের দুর্ব্যবহারঃনৌবাহিনীর ব্রিটিশ অফিসাররা ভারতীয় নাবিকদের সঙ্গে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করত। জাতিগত বৈষম্য ছিল প্রকট। ভারতীয়দের 'কুলি' বা 'কালো' বলে অপমান করা হতো। এই ধরনের বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ ভারতীয় নাবিকদের আত্মসম্মানে আঘাত হানত এবং তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
৩) আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রভাবঃ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজাদ হিন্দ ফৌজের (আই.এন.এ.) সেনাদের বিচার শুরু হয়। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই বাহিনী যে বীরত্ব ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিল, তা সমগ্র ভারতে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নৌসেনারাও এই দেশপ্রেমের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা তারা এখান থেকেই পেয়েছিল।
৪) রাজনৈতিক সচেতনতার বৃদ্ধিঃদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যরা গ্রিস, ইতালি ও বার্মার মতো বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করেছিল। এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়ে তোলে। তারা উপলব্ধি করে যে, ব্রিটিশরা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বললেও নিজেদের দেশে ভারতীয়দের বঞ্চিত করছে। এছাড়া, বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনও তাদের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করেছিল।
৫. তাৎক্ষণিক কারণঃনৌবিদ্রোহের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল একটি নির্দিষ্ট ঘটনা। এইচ.এম.আই.এস. তলোয়ার নামক জাহাজের নাবিক বি.সি. দত্ত জাহাজের দেওয়ালে "ভারত ছাড়ো" স্লোগান লিখেছিলেন। এর জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ সালে বোম্বাই-এর এইচ.এম.আই.এস. তলোয়ার জাহাজের নাবিকরা প্রথমে ধর্মঘট শুরু করে, যা দ্রুত অন্যান্য জাহাজ ও ঘাঁটিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,উপরিউক্ত কারণগুলির সম্মিলিত ফলস্বরূপ নৌবিদ্রোহের মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। আসলে এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, সামরিক বাহিনীতেও তাদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং ভারতের স্বাধীনতা এখন কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়।
Comments
Post a Comment