যে সামাজিক-রাজনৈতিক(4th.Sem) স্তর পরম্পরায় রবীন্দ্রনাথ ঘর ও বাইরে-র ব্যঞ্জনাকে দৃশ্যপটের মধ্যে উপস্থাপিত করেছেন তার পরিচয় দাও।
যে সামাজিক-রাজনৈতিক স্তর পরম্পরায় রবীন্দ্রনাথ ঘর ও বাইরে-র ব্যঞ্জনাকে দৃশ্যপটের মধ্যে উপস্থাপিত করেছেন তার পরিচয় দাও(পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চতুর্থ সেমিস্টার, বাংলা মেজর)।
আমরা জানি যে,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসটি একটি কালজয়ী রাজনৈতিক উপন্যাস। যে উপন্যাসটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং তার পরবর্তী সময়ের স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। এই রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ঘর' ও 'বাইরে'র দ্বৈততার ওপর ভর করে উপন্যাসঠটি পাঠকের দরবারে উপস্থাপন করেছেন। আর সেই উপস্থাপনে আমরা দেখতে পাই যে-
সুবিশাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ আমরা জানি যে 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের মূল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হল স্বদেশী আন্দোলন। যে আন্দোলন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন শুরু হয়। তবে উপন্যাসটিতে এই আন্দোলনের দুটি বিপরীতমুখী ধারাকে সামনে ঊতুলে ধরা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখি-
রবীন্দ্র-ভাবনার স্বাদেশীকতাঃ উপন্যাসটিতে আমরা দেখতে পাই যে,নিখিলেশের চরিত্রের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র ভাবনার স্বাদেশিকতার ধারাটি প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে নিখিলেশ কোনো উগ্র বা সহিংস জাতীয়তাবাদের সমর্থক নয়। সে মনে করে দেশের উন্নয়ন হওয়া উচিত সমাজের ভেতর থেকে। আর সেই কাজটি হওয়া দরকার গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে।যেমন দেশীয় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা।তার মতে, স্বদেশী মানে শুধু বিদেশি পণ্য বর্জন নয়, বরং দেশের মানুষদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। আর এটা হল প্রকৃত স্বাদেশিকতা। আর সেখানে-
সন্দীপের সহিংস স্বদেশীকতায় বিশ্বাসীঃ অন্যদিকে সন্দীপের চরিত্রের মাধ্যমে সেই সময়ের সন্ত্রাসবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারাটি প্রকাশ পেয়েছে। সন্দীপের কাছে দেশপ্রেম একটি আবেগপ্রবণ ও ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা, যেখানে সহিংসতা, দেশীয় পণ্য বর্জনের নামে জোরজবরদস্তি এবং স্বার্থসিদ্ধিই প্রধান। সে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোনো অনৈতিক কাজ করতেও পিছপা হয় না।আর সেখানে-
সামাজিক প্রেক্ষাপটঃ স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন মুসলিম সমাজের ভূমিকাও উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এসেছে। বঙ্গভঙ্গের পর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার ছাপও উপন্যাসে দেখা যায়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উগ্রতা অনেক মুসলিমকে এই আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সন্দীপের অনুসারীরা যখন মুসলিমদের ওপর জোর করে স্বদেশী দ্রব্য কিনতে বাধ্য করে, তখন এই বিভেদ আরও তীব্র হয়। নিখিলেশ এই বিভেদের বিরোধী ছিল এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছিল, যা তার আদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে বিবেচিত। যেখানে আমরা দেখতে পাই-
ঘর ও বাইরের দ্বৈততাঃ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই উপন্যাসে 'ঘর' এবং 'বাইরে'-এর ধারণাটি মূর্ত হয়ে উঠেছে।যে ধারণায়- ঘরঃবিমলার শান্ত, স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন এবং নিখিলেশের উদার ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করে 'ঘর'। নিখিলেশ বিমলাকে শুধু অন্তঃপুরের বধূ হিসেবে রাখতে চায়নি, বরং তাকে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার মানসিক বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিল। আর সেই বিকাশে- বাইরেঃ স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল পরিবেশ, সন্দীপের মোহময়ী ব্যক্তিত্ব এবং উগ্র দেশপ্রেমের আবেগই হল 'বাইরে'। এটি বিমলার জীবনে এক নতুন উত্তেজনা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসে, যা তার শান্ত ঘরকে অশান্ত করে তোলে।আর এই প্রেক্ষিতে-
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,উপন্যাসের মূল দ্বন্দ্বটি এই দুই দিকের টানাপোড়েনেই তৈরি হয়েছে। বিমলা যখন সন্দীপের প্রলোভনে পড়ে 'ঘরের' আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে 'বাইরের' দিকে ঝুঁকছে, তখন সে একদিকে যেমন স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি তার নৈতিকতার পতন ঘটছে। শেষ পর্যন্ত, নিখিলেশের ট্র্যাজেডি এবং বিমলার অনুশোচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, উগ্র জাতীয়তাবাদের চেয়ে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এবং সুস্থ সমাজ গড়ার আদর্শই শ্রেয়।
Comments
Post a Comment