বৈষ্ণব পদাবলী পঞ্চরস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করে এর মধুর রসের শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশ করো (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা মেজর)।
আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বৈষ্ণব পদাবলীতে পঞ্চরস হলো ভক্ত ও ভগবানের মধ্যেকার সম্পর্ককে উপলব্ধি করার পাঁচটি ভিন্ন উপায়। এই রসগুলো কেবল সাহিত্যিক বিভাজন নয়, বরং বলা যেতে পারে যে,এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতির প্রকাশ। আর বৈষ্ণব পদাবলীতে সেই পাঁচটি রস হলো-
শান্ত রসঃ এই রসে ভক্ত কৃষ্ণকে পরম ঈশ্বর বা স্রষ্টা হিসেবে দেখেন। এখানে কোনো ব্যক্তিগত বা আবেগপূর্ণ সম্পর্ক থাকে না, কেবল শান্ত ও নির্বিশেষ ভক্তি বিদ্যমান। ভক্ত সবকিছু ত্যাগ করে ভগবানে নিজেকে সমর্পণ করেন।
দাস্য রসঃ এই রসে ভক্ত নিজেকে কৃষ্ণের দাস বা সেবক হিসেবে দেখেন। এখানে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক প্রাধান্য পায়। ভক্ত কৃষ্ণের সেবা করতে নিজেকে ধন্য মনে করেন এবং তাঁর ঐশ্বর্য ও মহিমা দেখে শ্রদ্ধাবনত হন।
সখ্য রসঃ এই রসে কৃষ্ণ ভক্তের কাছে সখা বা বন্ধু। এখানে প্রভু-ভৃত্যের দূরত্ব ঘুচে যায় এবং এক ঘনিষ্ঠ, বিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভক্ত কৃষ্ণের সাথে খেলাধুলো করেন, হাসি-ঠাট্টা করেন এবং বন্ধুর মতোই তাঁর পাশে থাকেন।
বাৎসল্য রসঃএই রসে ভক্ত কৃষ্ণকে নিজের সন্তান হিসেবে দেখেন। মা যশোদার কৃষ্ণের প্রতি যে স্নেহ ও মমতা, তাই এই রসের মূল বিষয়। এই রসে ভক্তের মনে সন্তানের প্রতি স্নেহ, লালন-পালনের ইচ্ছা এবং তার নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ ফুটে ওঠে।
মধুর রসঃএটি বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ রস। এই রসে ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। এখানে কৃষ্ণকে কান্ত বা প্রেমিক এবং ভক্তকে কান্তা বা প্রেমিকা হিসেবে ভাবা হয়। রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা এই রসের মূল উপজীব্য।
•মধুর রসের শ্রেষ্ঠত্ব•
বৈষ্ণব পদে মধুর রসকে শ্রেষ্ঠ রস হিসেবে গণ্য করার প্রধান কারণগুলো নিম্ন সূত্রাকারে আলোচনা করা হলো-
১. পাঠ্য আধ্যাত্মিক নিয়মঃমধুর রস কেবল প্রেমের সম্পর্ক নয়, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার মধ্য জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন আকাঙ্ক্ষা। এই রসকে চারটি রসের পরিণতি বাকি বলা হয়। শান্ত রসে যে নির্বিশেষ ভক্তি, দাস্য রসে যে সেবা, সুখ রসে যে রসেতা এবং বাৎসল্য রসে যে স্নেহ, মধুর রসের মধ্যে সবকটিই বিদ্যমান।
২. গভীরতম প্রেমঃ গভীর প্রেমে আত্মনিবেদন মধুর রসে ভক্তের প্রেমের সব ধরনের ভয়, দ্বিধা ও সামাজিক গাণ্ডিকার করে। এখানে ভক্ত নিজেকে সম্পূর্ণ ভগবানের কাছে সমর্পণ করেন, যা অন্য কোনো রসেটা গভীর নয়। রাধার প্রেমের মাধ্যমে ভক্তরা শেখেন কীভাবে সহজে কৃষ্ণকে পেতে আকুল হতে হয়। এই আত্মনিবেদনই মধুর রসের মূল ভিত্তি।৩) মানবিক অনুভূতি প্রকাশঃমধুর রস কৃষ্ণকে কেবল পরম ঈশ্বরের মতো একজন মানবীয় সত্তা হিসাবে দেখান, যার সাথে প্রেম, বিরহ, মিলন—সবকিছুই সম্ভব। এই মানবিককরণ ভক্তদের সাহায্যে কৃষ্ণকে আরও সহজে নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে সাহায্য করে। রাধার বিরহ-দনা, অভিসারের আকুতি—এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতিরই প্রতিফলন।
৪. কাব্যিকময়তাঃ বৈষ্ণব পদকর্শ মধুর রসের পদগুলি কাব্যিক প্লাস্টিকে ভরপুর। চণ্ডীদা, বিদ্যা পীদাস, গোবিন্দ জ্ঞান প্রমুখ কবিরা ও কৃষ্ণের এই মধুর প্রেমকে অপূর্ব শৈলল্পিক বর্ণনা করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যকে এক ভিন্ন ভিন্ন চিত্র উন্নীত করেছেন। এই রসের পদের ভাবের গভীরতা, অলংকার প্রয়োগ এবং ভাষা মাধুর্য অসাধারণ।
৫. মুক্তি ও মিলনঃমধুর রসের লক্ষ্যের লক্ষ্য কৃষ্ণ বা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন মিলন। রাধা-কৃষ্ণের মিলনকে তাই ভক্ত ও ভবানের চিরন্তন মিলনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এটি কেবল একটি প্রেম কাহিনি নয়, ভক্তের মুক্তি ও পরম আনন্দের পথ।আর সেখানে-
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, উপরোক্ত কারণে বৈষ্ণব পদাবলীতে মধুর রসকে সব রসের শ্রেষ্ঠ ও "রসবৈরাগ্যের চরম শিখর" হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এটি কেবল একটি সাহিত্যিক ধারা নয়, বরং ভক্তদের আধ্যাত্মিক সাধনার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, উপায়।
Comments
Post a Comment