একটি সার্থক গীতিকাব্যের পরিচয়-সারদা মঙ্গল
•আলোচনার শুরুতেই আমরা বলে রাখি যে,বিহারীলাল চক্রবর্তী রচিত 'সারদা মঙ্গল' কাব্যকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গীতিকাব্য হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে উনিশ শতকে যখন বাংলা সাহিত্য মহাকাব্য ও আখ্যায়িকা কাব্যের ধারা থেকে সরে নতুন দিকে মোড় নিচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে 'সারদা মঙ্গল' কাব্যটি গীতিকাব্যের আঙিনায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আর সে কারণেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্যকে 'ভোরের পাখি' বলে অভিহিত করেছিলেন। যেখানে সারদা মঙ্গল গীতিকাব্যটি বাংলা সাহিত্যের এই নতুন ধারার শুভ সূচনা করেছিল। আর এই প্রেক্ষিতে আমরা সারদা মঙ্গল কে গীতিকাব্য বলছি তার কারন-
•গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্যের নিরখে'সারদা মঙ্গল' কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি কবির ব্যক্তিগত অনুভূতির কাব্য। যে কাব্যটিতে কোনো নির্দিষ্ট গল্প বা কাহিনি নেই। তবে সেখানে আছে-কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী নিজে দেবী সারদার (জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী) প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। যে উক্তি ও ভালোবাসা কবির অন্তরের গভীর আনন্দের প্রকাশ। আর সেই ভালোবাসার মাঝে কবি নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলীন করে সারদার সান্নিধ্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন। যেখানে পাই সারদা মঙ্গল কাব্যের-
•বিষয়বস্তু ও ভাবের' দিক থেকে সারদা মঙ্গল' কাব্যটি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। আর সেই ভাগ গুলি হল-•'নিসর্গ সন্দর্শন',• 'সঙ্গীত শতক' এবং •'সারদামঙ্গল'।
•সারদা মঙ্গল কাব্যে 'নিসর্গ সন্দর্শন' অংশে কবি প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। এখানে তিনি প্রকৃতিকে কেবল দৃশ্য হিসেবে দেখেননি, বরং বলা যেতে পারে যে,প্রকৃতির মধ্য দিয়ে এক অদৃশ্য ও রহস্যময় সত্তাকে অনুভব করেছেন, যা দেবী সারদা। প্রকৃতির অপরূপ রূপের মধ্য দিয়ে কবির হৃদয়ে এক ঐশ্বরিক অনুভূতি জেগে উঠেছে। পাশাপাশি-
•'সঙ্গীত শতক' অংশে কবির আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। এখানে তিনি জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর ভাবনা প্রকাশ করেছেন, যা সুরের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে আমরা তৃতীয় ভাগে দেখি-
•'সারদামঙ্গল' অংশে কবি সরাসরি দেবী সারদার বন্দনা করেছেন। তিনি সারদাকে কেবল জ্ঞানের দেবী হিসেবেই দেখেননি, বরং তাকে একজন চিরন্তনী নারী, প্রেমিকা এবং জীবনের সকল সৌন্দর্যের উৎস হিসেবে দেখেছেন।
• সারদা মঙ্গল কাব্যের ভাষা ও ছন্দের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে,এই কাব্যের ভাষা অত্যন্ত সহজ, সাবলীল এবং স্বতঃস্ফূর্ত।তবে এখানে কবি বিহারীলাল ভারী সংস্কৃত শব্দ বা অলংকারের ব্যবহার এড়িয়ে চলেছেন।যার ফলে, কবির গভীর অনুভূতি সহজেই পাঠকের মনে প্রবেশ করে। কাব্যটিতে ছন্দ ও লয়ের একটি স্বাভাবিক প্রবাহ আছে, যা একে আবৃত্তির চেয়ে গাওয়ার উপযোগী করে তুলেছে।এই গীতিময়তাই কাব্যটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
•রবীন্দ্র প্রভাবে আমরা দেখতে পাই যে,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বিহারীলালের এই কাব্য থেকে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়,তিনি 'সারদা মঙ্গল'-এর প্রশংসা করে বলেছিলেন- "সারদা মঙ্গল হলো 'নূতন ছন্দ, নূতন সুর, নূতন ভাষা, নূতন ভাব লইয়া বাংলা কাব্যের প্রথম অভ্যুদয়।" •আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতায়, বিশেষত প্রকৃতির বর্ণনা এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশে, বিহারীলালের প্রভাব দেখা যায়। এই কাব্যটিই রবীন্দ্রনাথকে গীতিকাব্য রচনার দিকে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে এক দিগন্ত উন্মোচিত করে।
•পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,'সারদা মঙ্গল' কাব্যটি কেবলমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং এটি বাংলা কাব্যের গতিপথ পরিবর্তনকারী একটি মাইলফলক। আর এটি প্রমাণ করে যে, কাব্য শুধু গল্প বা যুদ্ধের কাহিনি নয়, বরং কবির হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমও হতে পারে। সেই গভীরতম অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সারদা মঙ্গল কাব্যের মধ্য দিয়ে। আসলে এই কাব্যের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্য মহাকাব্যের বন্ধন ভেঙে এক নতুন, আত্মগত ও গীতিময় ধারার জন্মলগ্ন সূচিত হয়।
ঠিক এরূপ অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ব্যাখ্যা সাজেশন ভিডিও পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং আমাদের SHESHER KOBITA SUNDARBAN Youtube channel 🙏
Comments
Post a Comment