প্রশ্নঃ জাতি ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করো।
জাতিঃ আলোচনার শুরুতেই আমরা বলতে পারি যে, ইংরেজি নেশন শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো জাতি। তবে এই জাতি বলতে সঠিক কি বোঝায় তা এক কথায় বলা একটু কঠিন। এই জাতি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন বিভিন্ন দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রমুখ। আর সেই ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে অধ্যাপক ল্যাক্সি বলেন-
"জাতির সংজ্ঞা নির্ণয় করা খুব কঠিন বিষয়। কারণ কোন বিচার্য বাহ্যিক উপাদানের ভিত্তিতে তাকে চিহ্নিত করা যায় না।"
আসলে ভাষা কিংবা জৈবিক ভিত্তিতে জাতি সৃষ্ট হয় না। জাতি হল এক জীবন্ত আধ্যাত্মিক নীতির মূর্ত রূপ। কোন গৌরবোজ্জ্বল বা দুঃখময় অতীত স্মৃতির বন্ধন এবং একই রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছাই একটি জনসমাজকে জাতিতে পরিণত করে। আর এখানে বিখ্যাত দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-
"নেশন একটি সজীব সত্তা, একটি মানস পদার্থ।"
মোট কথা হলো, জাতি হল ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত এমন একটি স্থায়ী জনসমাজ, যাদের ভাষা এক, বাসভূমি এক, অর্থনৈতিক জীবন এক, মানসিক গঠনও এবং এই মানসিক গঠন একটি সাধারণ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। সুতরাং-
জাতি= জাতীয় জনসমাজ +জাতীয়তাবোধ/ রাষ্ট্র।
রাষ্ট্রঃ রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বোঝায়, যা কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্র সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার ভেতর বসবাসকারী সমাজের সদস্যদের শাসনের জন্য নিয়ম-কানুন তৈরি করে। যদিও একথা ঠিক যে রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাওয়া না পাওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে, রাষ্ট্র হিসেবে তার উপর প্রভাব রাখা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির উপর।
আবার অনেকে জাতি এবং রাষ্ট্রকে অভিন্ন বলে মনে করে থাকেন। তবে ফরসি বিপ্লবের সময় জাতীয় রাষ্ট্র(Nation State)ধারণার উদ্ভব ঘটে। আর সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশের প্রাথমিক পর্বে উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণী অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরির উদ্দেশ্যে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের স্লোগান তুলেছিল। আর তখন থেকেই জাতি ও রাষ্ট্রকে অভিন্ন হিসেবে দেখার প্রবণতার লক্ষ্য করা যায়। এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বার্কার বলেন যে--
"আঞ্চলিক জাতি র ওপর রাষ্ট্রের ছাপ পড়ার ফলে জাতি, জাতীয় সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্র 'জাতীয় রাষ্ট্রে' রূপান্তরিত হয়।"
আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক জাতি এক রাষ্ট্র এর তত্ত্ব বিশেষভাবে জনপ্রিয় হওয়ার ফলে জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা দ্রুত বিলীন হয়ে পড়ে। তবে সেই যাই হোক জাতি এবং রাষ্ট্র এক ও অভিন্ন নয়। কারণ--
প্রথমতঃ রাষ্ট্র হল মূলত একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু জাতীয় জনসমাজ হল একটি সাংস্কৃতিক সত্তা। আর এদিক থেকে বিচার করে বলা যেতে পারে যে, নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার চেতনাই হলো জাতির ভিত্তি এবং জাতির ধারণা হলো সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক। তবে জনসাধারণের আনুগত্যের উপর ভিত্তি ক'রে রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমে রূপায়িত হয় যাতে কিন্তু এ ধরনের কোন মাধ্যম নেই কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য থাকলেই তাকে জাতি বলে অভিহিত করা যায় না। সেই জনগোষ্ঠী পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করলে কিংবা রাত্র গঠনের সফল হলে তাকে জাতি বলা হবে তবে অনেক সময় রাষ্ট্রের উদ্ভব করলেও জাতির উদ্ভব নাও করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও ওই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে কেবল রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া অন্য কোন ধরনের ঐক্য না থাকায় তা একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি।
তৃতীয়তঃ একটি রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতির অস্তিত্ব থাকতে পারে। এরূপ রাষ্ট্র বহুজাতিক রাষ্ট্র নামে পরিচিত। ভারত হল একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ধরনের রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিসত্তা তাদের স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য রক্ষার সুযোগ না পেলে 'এক জাতি এক রাষ্ট্র' গঠনের দাবি ওঠে। যার ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে।
সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কতকগুলি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। কিন্তু বুর্জোয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনেতারা শ্রেণীবিভক্ত সমাজের শ্রেণীগত বিন্যাস ও শ্রেণী দ্বন্দ্বকে আড়াল করার উদ্দেশ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রচার করেন।
আরও বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন আমাদের "SHESHER KOBITA SUNDORBON"
YOUTUBE CHANNEL ।
Comments
Post a Comment